প্রকল্প বিলম্বে কত হাজার কোটি টাকা গচ্ছা গেছে তা প্রকাশ পেলে জনগণ ধিক্কার দিবে,এ এম এ মুহিতের জন্মদিনের আলোচনায় : ড. মোমেন
তিন বছরের প্রজেক্ট, ৭-৮ বছরে শেষ হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তার মতে, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতায় জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানি যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়তি বাজেট গুনতে হয়, যা গরীবের রক্তচোষা অর্থ। তবে তিনি বলেন, আশার দিক হচ্ছে বাংলাদেশে জাপানীদের নেয়া প্রজেক্টগুলো যথা সময়েই শেষ হয়। তারা অর্থ বাঁচায় এবং তা সরকারি কোষাগারে ফেরৎ দেয়। যথাসময়ে প্রজেক্ট শেষ না হওয়ার ফলে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত কত হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই- এমন মন্তব্য করে ড. মোমেন বলেন, এ অর্থের হিসাব প্রকাশ হলে দেশবাসী প্রজেক্ট সংশ্লিষ্টদের ধিক্কার দিবে এবং ঘৃণা করবে। শনিবার ত্রিকালদর্শী কর্মবীর প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত স্মরণ সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে শনিবার বিকালে এ এম এ মুহিত ট্রাস্ট ওই আলোচনা ও স্মরণিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন এমপি। বক্তব্য রাখেন ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য একে আজাদ, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) ইনাম আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন, সাবেক এমপি এরোমা দত্ত এবং সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, এনজিও ব্যক্তিত্ব ড. আহমদ আল কবির, মুহিত তনয় শাহেদ মুহিত, মানবজমিনের কূটনৈতিক রিপোর্টার মিজানুর রহমান, চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার রিজভী নেওয়াজ, সিলেট বিভাগ যোগাযোগ ও পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন সোহেল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এ এম এ মুহিত ট্রাস্টের কার্যকরী সদস্য জালাল আহমেদ, ধন্যবাদ জ্ঞাপন তথা সমাপনী বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সদস্য সচিব আলাউদ্দিন আল আজাদ। অনুষ্ঠানে আবুল মাল আবদুল মুহিতের সহোদর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন তার দায়িত্বপালনকালীন স্মৃতিময় ঘটনাগুলো স্মরণ করেন। বলেন, ব্যাংকিং এবং পুুঁজিবাজারে অদৃশ্য হাতের কারসাজি বাদ দিলে আবুল মাল আবদুল মুহিতের দায়িত্বপালনকালীন ১০ বছরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সম্মান ও মর্যাদার আসন দিয়েছে।
তিনি ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ। ২০০৯ সালের একটি ঘটনা স্মরণ করে মোমেন বলেন, আমি তখন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের জন্য তখন মাসে ৩৯ হাজার ডলার ভাড়া গুনতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মিশনের জন্য একটি অফিস কেনার সিদ্ধান্ত হলো। কেনাকাটার জটিল প্রক্রিয়া পার হতে বেশ কষ্ট হলো। সেই ক্রয়ের সম্ভাব্যতা এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঠিকতা যাচাইয়ে ঢাকা থেকে একটি প্রাক-মূল্যায়ন টিম যাওয়ার কথা ছিলো। বেশ সিনিয়র সদস্যদের টিম। তাদের বেশিরভাগের ছেলে বা মেয়ে আমেরিকায় অধ্যয়নরত। বলা হলো টিম মে-জুন মাস ছাড়া যেতে পারবে না। কারণ ওই সময়ে তাদের সন্তানদের সেশন শেষ হবে। কিন্তু আমার তো তাড়া। ডিসেম্বরের মধ্যে ক্রয় প্রক্রিয়া ক্লোজ না করলে বুকিং মানি গচ্ছা যাবে। যাক পরবর্তীতে এটা সমাধান হলো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ফজলে কবীরের নেতৃত্বে একটি টিম গেলো এবং সেই বাধা কাটলো। এবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বললো মর্গেজ ছাড়া অফিস কেনা যাবে না। কিন্তু কোন ব্যাংক মর্গেজ দিতে রাজি হচ্ছিলো না। একটি ব্যাংক রাজি হলো, কিন্তু ইন্টারেস্ট রেট ৩ শতাংশ বাড়িয়ে চার্জ করলো। মিশন প্রধান হিসাবে আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওই সময়ে অন্য একটি কাজে অর্থমন্ত্রী মুহিত নিউ ইয়র্কে গেলেন। তিনি নিজে থেকেই জানতে চাইলেন মিশন কেনার ঝামেলা মিটেছে কিনা? বাড়তি ইন্টারেস্ট রেটের বিষয়ে অবহিত করা হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন আমি নগদ পরিশোধ করে দিচ্ছি। এই ছিলেন মুহিত। তিনি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিলেন। তাৎক্ষণিক লোন পরিশোধে আমাদের অনেক অর্থ সাশ্রয় হয়।
ড. মোমেন তার বক্তৃতায় আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী বরাবরই কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ এবং তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করার তাগিদ দেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিত সাহেবও প্রত্যেকটি প্রজেক্ট যথাসময়ে শেষ করার ওপর জোর দিতেন। তিনি স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু দুর্ভ্যাগ্য, আমাদের দেশে ৩ বছরের প্রজেক্ট, ৭-৮ বছরে শেষ হয়। এ সময় নির্ধারিত সময় ও বাজেটে প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সাউথ কোরিয়ার একজন জেনারেলের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের উদাহরণ টানেন ড. মোমেন। সামনে দিনে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা বা চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা ব্যক্ত করে সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-০৯ সালে বিশ্ব মন্দার ফলে আমাদের মতো পরনির্ভরশীল ওপেন ইকোনমিতে ধাক্কা এসেছিলো। কিন্তু তখন মুুহিত সাহেবের মতো দায়িত্বশীল, কর্মঠ, বাস্তবাদী এবং ভিশনারী লোকের কারণে সেই ধাক্কা কেবল সামাল হয়নি, অভাবনীয় সাফল্য অর্জনে বাংলাদেশ সমর্থ হয়েছিলো। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ, বিশ্ববাজারে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা হারানোর আশঙ্কার বিপরীতে নতুন নতুন সম্ভাবনাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, প্রজেক্টগুলো কিভাবে অন-টাইম সম্পন্ন করা যায় ইত্যাদি বহুবিধ সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন আরেকজন আবদুল মাল আবদুল মুহিত।
অনুষ্ঠানে সাবেক সংসদ সদস্য মানবাধিকার কর্মী এরোমা দত্ত আবুল মাল আবদুল মুহিতকে সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙ্গালীদের অন্যতম উল্লেখ করে তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে নেয়ার দাবি জানান। এদিকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ তার বক্তৃতায় আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওপর ডকুমেন্টারি করার প্রাণবন্ত বর্ণনা দেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রতিবছর কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণের বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন। বিরল ওই ব্যক্তিত্বের ভালোবাসার কাছাকাছি যাওয়াকে সৌভাগ্য বলে উল্লেখ করেন বিনয়ী শাইখ সিরাজ।
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, আবুল মাল আব্দুল মুহিত ছিলেন বহু গুণের অধিকারী একজন আলোকিত মানুষ। অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে বহুবিধ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক মুহিতের মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। ভাষা সৈনিক, কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা বহুমাত্রিক পরিচয়ের অধিকারী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জাতির ভাগ্যোন্নয়নে নিজের অবস্থান থেকে যে বলিষ্ঠ অবদান রেখে গেছেন তা দলমতনির্বিশেষে সবার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন বক্তারা। তারা বলেন, মুহিত যেমনি সৎ, আদর্শবান ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন, তেমনি তিনি আঞ্চলিকতা, সম্প্রদায়িকতা, স্বার্থপরতা তথা সব রকম অসুস্থ প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি সর্বাবস্থায় সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সৎ সাহস রাখতেন। তিনি জীবনটাকে বর্ণাঢ্য করে গেছেন তার কর্ম দিয়ে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা পুরোপুরি মুছে দিয়ে বাংলাদেশকে মধ্যমআয়ের দেশের পথে এগিয়ে নিতে যে অর্থনীতির প্রয়োজন তার বুনিয়াদ রচনায় যেক’জন মানুষের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে মুহিত তার অন্যতম।