মন্ত্রী-এমপিরা হলফনামায় দেশকে শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরিয়ে নিয়েছেন: রিজভী
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের হিসাব ‘আলাউদ্দিন চেরাগের কাহিনীর মতো’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
আজ বুধবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের হলফনামার চিত্র তুলে ধরে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রিজভী বলেন, ‘আসন্ন একদলীয় পাতানো নির্বাচন উপলক্ষে মন্ত্রী-এমপি-ডামি-উচ্ছিষ্টভোগী স্বতন্ত্রদের হলফনামা পড়লে মনে হয় যেন আরব্য উপন্যাসের সেই বিখ্যাত আলাউদ্দিনের চেরাগ…কারোটা দেখলে মনে হয় সাদ্দামের বেহেস্তে তারা বসবাস করছেন। তাদের বাড়ি-গাড়ি, বিদেশে অভিজাত এলাকায় তাদের অ্যাপার্টমেন্ট, তাদের ডুপ্লেক্স সবকিছু মিলেই মনে হয় যে, তারা বেহেস্তে বসবাস করছেন।’
তিনি বলেন, ‘নিশিরাতের ভোট ডাকাত সরকারের ৫ বছর থেকে ১৫ বছরের মন্ত্রী-এমপি ও তাদের নেতারা অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, অনেকে প্রায় আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় বটগাছ হয়েছেন। তাদের স্ত্রী-সন্তান-শ্বশুররাও টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছেন।’
‘সাধারণ ব্যবসায়ীদের লোকসান হলেও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকদের কোনো লোকসান নেই’ মন্তব্য করে রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী রাজনীতি এমন এক ব্যবসা যেখানে কোনো ঝুঁকি নেই এবং লোকসান হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। যে ব্যবসাই করছেন তাতেই লাভ আর লাভ। শেয়ার ব্যবসায় তারা কেউ ক্ষতির মুখোমুখি হননি। কৃষিখামার ও মাছের ব্যবসাতেও বহু গুণ লাভ করেছেন। স্বামীদের ব্যবসা দেখাশোনা করতে গিয়ে স্ত্রীরাও কোটি কোটি টাকা অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন।’
‘হলফনামা ধরে প্রতিদিন প্রাত্যহিক সংবাদপত্রে নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে তা দেখে জনগণের চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা। তারা ভাবতে থাকে আমরা কি একটা বাস্তব জগতে বাস করছি? এ যেন সেই রুপকথার জগত, নাকি কল্পনার স্বর্গরাজ্যে বাস করছি, এটাও সম্ভব। একেকজন মানুষের সম্পদ ২০০ গুণ, ৩০০ গুণ, ৪০০ গুণ ৫০০ গুণ, কেউ আবার পাঁচ বছরে ৭০০ গুণ সম্পদেরও মালিক হয়েছেন,’ বলেন তিনি।
রিজভী বলেন, ‘অবস্থা এমন হয়েছে যে, টাকার পাহাড়ে ঘুমান মন্ত্রী-এমপি-নেতারা। যে মন্ত্রী-এমপি নিজেকে কৃচ্ছ্যতা সাধনের বরপুত্র বলে জাহির করতেন, কিংবা যিনি জনসমক্ষে সততার পরাকাষ্ঠ প্রদর্শনের নাটক করতেন, তাদের শঠতার বিভৎসভাবে জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। যারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের প্রায় সবারই নগদ অর্থকড়ি-বিত্ত সম্পদ দ্বিগুণ থেকে প্রায় হাজার গুণ স্ফীত হয়েছে।’
‘আওয়ামী জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় কারও হয়েছে সম্পদের পাহাড়, কারো গাড়ির বহর। দশ বছর আগে যে মন্ত্রীর হলফনামায় হাজারের ঘরে ছিল বার্ষিক আয় তিনিও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সবাই জানি তাদের হলফনামায় সম্পদের সামান্যই প্রদর্শন করা হয়েছে। অবৈধ অর্থ, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ, সেকেন্ড হোম, বিদেশে গচ্ছিত বেশুমার সম্পদের হিসাব নেই। যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের ব্রতই যেন লুটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া। লুটেরা রাজ্যের সম্পদ ছিটেফোঁটা মাত্র এই হলফনামায় উঠে এসেছে। এমপি-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও অনেক তথ্য গোপন করছেন,’ বলেন তিনি।
রিজভী আরও বলেন, ‘প্রতিটি হলফনামার অবস্থা তথৈবচ। হলফনামায় তারা যেসব সম্পদের কথা বলেছেন, এটা তো নগণ্য। আসলে বাস্তবে এর চাইতে আরও কত গুণ তাদের সম্পদ যেটা তারা আড়াল করেছেন। অর্থবিত্ত সম্পদের ছিটেফোঁটার হিসাব দিলেও, কোনো কোনো মিথ্যেবাদী মন্ত্রী-এমপিরা তাদের হলফনামায় দেশকে শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরিয়ে নিয়েছেন। যে শাসনামলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। শেখ হাসিনার আদর্শিক কিছু অটোপাস এমপি লুটের অর্থসম্পদ কম দেখাতে তাদের প্রায় সবাই গাড়ি, বাড়ি, জমি-জিরাত-খামার-বাড়িভাড়া, সোনা-দানা-অলংকারসহ সব কিছুর মূল্য অতি সামান্য দেখিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে তারা এখনো শায়েস্তা খাঁর আমলে বাস করছেন।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুর রহমান চৌধুরী হলফনামায় তার ১০০ ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন মাত্র এক লাখ টাকা। এ হিসাবে তার কাছে গচ্ছিত প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম পড়েছে এক হাজার টাকা, কুমিল্লা-৭ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২২ ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন ২১ হাজার টাকা। প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন ৯৫৫ টাকা। এটা কি পাগলে বিশ্বাস করবে।’
‘আওয়ামী মাফিয়া রাষ্ট্রে এমপি বা মন্ত্রিত্ব যেন আলাদিনের চেরাগ’ মন্তব্য করে রিজভী বলেন, ‘চোখের পলকে উন্নতি, অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার নেপথ্য রহস্য জানে প্রতিটি মানুষ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন তার ছোট্ট উদাহরণ। প্রতিটি মন্ত্রী-এমপির বিমূর্ত অবয়ব তিনি। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার জন্য দেওয়া ৯৪ লাখ ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের হাতে তার মিন্টো রোডের ১১ নম্বর সরকারি বাসভবনে নির্মম মারধরের শিকার হয়েছেন পুলিশ সদস্যসহ তিন ভুক্তভোগী অসহায় ব্যক্তি। প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগ বাণিজ্য ও গুন্ডামির এই খবর পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশন-অনলাইনে ছড়িয়ে যাওয়ার পর টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে ১০ ডিসেম্বর ৭ জনের কাছ থেকে নেওয়া সাড়ে ৯ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন প্রতিমন্ত্রী।’
‘এসব অর্থ-সম্পদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন একেবারেই অন্ধ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জুলুমের প্রতিষ্ঠান দুদক বিরোধী দলের ওপর ধারালো তরবারি নিয়ে দৌড়াতে থাকে। আর আওয়ামী লুটেরা গোষ্ঠী সম্পর্কে তারা নীরব, নিশ্চুপ। তখন তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়।’
‘দুদককে দলকানা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। তাদের কাজ হলো খুঁজে খুঁজে বিএনপি ও ভিন্নমতের ব্যক্তিদের ঘায়েল করা। রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে এই তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে,’ যোগ করেন তিনি।
রিজভী বলেন, ‘বাস্তবতা হলো মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের এই সম্পদ, এই টাকার পাহাড় কীভাবে গড়ে উঠেছে, আয়ের উৎস কী, এসব নিয়ে শেখ হাসিনার মাথাব্যথা নেই। জবাবদিহিতা নেওয়ার কেউ নেই। কারণ, সবকিছু আওয়ামীময় নষ্টদের অধিকারে। বর্গীদের মতো লুটের রাজ্য ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে টপ টু বটম ব্যস্ত।’
‘তারা জনগণের সম্পদ চেটেপুটে খেয়ে পেট মোটা করতে এসেছেন। লুটের শাসন স্থায়ী করতে খুন-গুম-হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার মিথ্যা সাজা দেওয়া হচ্ছে। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক তরফা নির্বাচনের নাটক করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে অন্ধ হয়ে পড়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৪০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করে রিজভী বলেন, ‘৯টি মামলায় ৯২৮ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।’