অলিম্পিকে বোল্ট-ফেল্প্সের আলো

জিকা ভাইরাসের ভয় ছিল, ছিল অপরাধপ্রবণ রিও ডি জেনিরোতে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাও। গুয়ানাবারা সৈকতের দূষিত পানিতে সেইলিং আর সার্ফিং করা যাবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হয়েছে রাশিয়ার ডোপ কেলেঙ্কারি নিয়ে।
পেছন ফিরে তাকালে এখন সেসব শঙ্কা আর বিতর্ক কি ম্লান মনে হবে! সব ছাপিয়েই উজ্জ্বল রিও অলিম্পিক ২০১৬। সেখানে অর্জনে উজ্জ্বলতম কাউকে খুঁজে পেতে একটুও কষ্ট করতে হবে না। রিও অলিম্পিকে যত আলো সবই তো ছড়িয়েছেন উসাইন বোল্ট আর মাইকেল ফেল্প্স! অলিম্পিকের বছর বলেই এটা বোল্ট-ফেল্প্সের বছর।
বোল্টকে নিয়ে মনে হয় না কোনো সংশয় ছিল। লন্ডন অলিম্পিকের ২৬ বছর বয়সী বোল্ট রিওতে তিরিশে পড়েছেন সত্যি, কিন্তু এ মর্ত্যধামে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো স্প্রিন্টারের আবির্ভাব হয়নি। তবে ফেল্প্স কতটুকু কী করতে পারেন, সেটা দেখার আগ্রহ ছিল অনেকের। লন্ডনেই ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিলেন। সেই ফেল্প্স অবসর ভেঙে আবার ফেরেন সুইমিংপুলে। কিন্তু সেই ফিটনেস আর জয়ের তাড়না আগের মতো আছে কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে অনেকের মনে।
ফেল্প্স প্রমাণ করলেন, তিনি জলমানবই আছেন। সবচেয়ে বেশি সোনার পদকের রেকর্ড আগে থেকেই ছিল। এবার আরও ৫টি সোনা জিতে সংখ্যাটা ২৩ করেছেন। শুধু ১০০ মিটার বাটারফ্লাইতেই পারেননি। সিঙ্গাপুরের ‘একলব্য’ জোসেপ স্কুলিংয়ের কাছে সোনা হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে তাঁর অলিম্পিক পদক হলো ২৮টি। আগেই ইতিহাস গড়া ফেল্প্স রিওতে গিয়ে অলিম্পিক ইতিহাসে নিজের নামটিকে অক্ষয় করে রাখার কাজটি সেরেছেন।
আর বোল্ট? অলিম্পিকে দুবার ‘স্প্রিন্ট ডাবল’-ই জেতা হয়নি কারও পক্ষে। বোল্ট যা লন্ডনেই জিতেছেন। রিওতে গিয়ে ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার—দুটিই জিতলেন। টানা তৃতীয়বার। সঙ্গে নিয়ম মেনে টানা তৃতীয়বারের মতো ১০০ মিটার রিলের সোনা যোগ। যা আসলে ‘ট্রেবল ট্রেবল’। লন্ডনে কিংবদন্তি হতে চেয়েছিলেন। রিওতে পেতে চেয়েছিলেন অমরত্ব। সেটি যে পেয়ে গেছেন, তাতে মনে হয় না এ গ্রহের কারও সন্দেহ আছে।
আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, দুই কিংবদন্তিরই এটা ছিল শেষ অলিম্পিক। ফেল্প্স তো সাঁতারকেই চূড়ান্ত বিদায় বলে দিয়েছেন। বোল্ট আগামী বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে থাকবেন, তবে অলিম্পিকে যে থাকবেন না সেটি নিশ্চিত করে দিয়েছেন।
দুই কিংবদন্তির কীর্তির ভিড়ে রিও অলিম্পিকে নতুন বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে ২৭টি, অলিম্পিক রেকর্ড ৯১টি। পদক তালিকায় যথারীতি যুক্তরাষ্ট্রের দাপট। তবে এত এত অ্যাথলেট নিষিদ্ধ হওয়ার পরও রাশিয়ার চতুর্থ হওয়াটা কম কথা নয়।
ব্যক্তিগত অর্জনের কথা আলাদা করে বললে আসবে আমেরিকার কেটি লেডেকির নাম। মেয়েদের ২০০, ৪০০ ও ৮০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে বিরল ট্রেবল জেতেন ১৯ বছর বয়সী এই সাঁতারু। জিমন্যাস্টিকসের ২০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একই সঙ্গে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও অলিম্পিকে মেয়েদের অল-অ্যারাউন্ডে সোনা জিতে নেন আমেরিকার সিমোন বাইলস। এককে আরও দুটি ও দলগত একটি সোনাসহ মোট চারটি সোনা জিতেছেন এই জিমন্যাস্ট। লন্ডনের পর রিওতেও ১০ হাজার মিটার ও ৫ হাজার মিটার দৌড়ে সোনা জিতে ‘ডাবল ডাবল’ পূর্ণ করেছেন যুক্তরাজ্যর সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত অ্যাথলেট মো ফারাহ।
অনেক কীর্তির ভিড়ে আবেগময় মুহূর্তও ছিল। ডোপ কেলেঙ্কারিতে নিষিদ্ধ হতে হতে শেষ পর্যন্ত রিওতে ছাড়পত্র পেয়েছিলেন রাশিয়ার ২৭১ জন ক্রীড়াবিদ। অ্যাথলেটিকস দলের কারও যাওয়া হয়নি। সেই রাশিয়ার হয়ে বেসলাম মুদরানভ রিওর প্রথম সোনা জেতেন জুডোর ৬০ কেজিতে। তাঁর সেই উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে যায় গোটা রুশ দলকেই।
মেয়েদের ৫ হাজার মিটারে ট্র্যাকেই ধাক্কা লেগে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাবি ডি-অগোস্টিনো ও নিউজিল্যান্ডের নিকি হ্যামব্লিনের মধ্যে। দুজনই পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু উঠে কেউ কাউকে ফেলে দৌড় দেননি। বরং পদকের কথা না ভেবে একজন উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন অন্যজনকে। হাত ধরাধরি করে শেষ করেছেন দৌড়। পেছন ফিরে তাকালে চোখে ভাসবে এই আবেগঘন মুহূর্তগুলোও।
ফেল্প্সকে হারানো স্কুলিং
অলিম্পিকে নিজের দেশের জন্য প্রথম সোনা জয়। আর সেটা যদি হয় মাইকেল ফেল্প্সের মতো কিংবদন্তিকে হারিয়ে, তাহলে আনন্দটা কেমন হতে পারে? উত্তরটা সবচেয়ে ভালো দিতে পারবেন জোসেফ স্কুলিং। সর্বকালের সেরা সাঁতারুকে তাঁরই প্রিয় ইভেন্ট ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে পেছনে ফেলে রিওতে সোনা জিতেছেন সিঙ্গাপুরের ২১ বছর বয়সী স্কুলিং। ছোটবেলা থেকেই যিনি আদর্শ মেনে এসেছেন ফেল্প্সকে। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের আগে ফেল্প্সরা অনুশীলন করেছিলেন সিঙ্গাপুরে। তখন অনেক কষ্টে গুরুর সঙ্গে একটা ছবিও তুলেছিলেন স্কুলিং। ফেল্প্সকে হারানোর পর দুজনের যে ছবি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।