টরেন্টো এখন ভুতের শহর
করোনায় থমকে গেছে বিশ্ব। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যেই পৃথিবী উলটপালট হয়ে গেছে। এর ব্যত্যয় ঘটেনি উত্তর আমেরিকাতেও। এখন পর্যন্ত কানাডাতে প্রায় ২১ হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মারা গেছেন ৫০৯জন। জরুরি অবস্থা জারির কারণে আমাদের ব্যস্ত নগরী টরেন্টো অনেকটাই ভুতের শহরের রুপ পেয়েছে। চারদিক নিথর নিঝুম।সুনসান নীরবতা। তড়িঘড়ি করে কাউকে আর গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায় না। শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলো ফাঁকা। স্কুলের মাঠ , পার্ক সব ফাঁকা কোথাও কেউ নেই। কর্মব্যস্ত শহরের এই রুপ সত্যি বেমানান ।তবু মানবিক রাষ্ট্র মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো উত্তম পদক্ষেপ নিতে ভুল করেননি।ভুল করেনি স্বাস্হ্যবিভাগ।খাওয়া দাওয়া অর্থের সংকট নেই।ঘরে বসেই মিলছে।কেবল জীবন যাত্রা অচল স্হবির হয়ে গেছে।সামাজিক দূরত্বই নয় মানুষ কার্যত স্বপ্রনোদিত হয়ে সরকারের নির্দেশে কোয়ারেন্টাইনে বা গৃহবন্দী হয়ে আছে।
আজ দুই সপ্তাহের বেশি আমরা সবাই টরেনটোতে গৃহবন্দী। বেশীর ভাগ মানুষের কাজে যাওয়া নেই,ঘরে ফেরা নেই। ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজ নেই, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া নেই। আমরা কেউ কারও বাসায় যাচ্ছি না, বাঙালীরা বাংলা রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা আর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে না! ভাবাই যায় না এমন দিন যাপন।
দিন-মাস তারিখ বার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে করতে হচ্ছে আজ কি বার । জীবনের সমস্ত রুটিন আজ ওলট পালট হয়ে গেছে। ঘুম, খাওয়া , শরীরচর্চা কোনটাই আর সময়মতো করা হচ্ছে না দেরি করে ঘুম থেকে উঠা , দেরী করে ঘুমাতে যাওয়া , লান্চ . ডিনার সবকিছুই আজ রুটিনের বাইরে ।কেমনজানি একটা অদ্ভুত রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। এই অস্বাভাবিক অবস্থাকেই এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এমন কখনো হয়নি। চিন্তায়ই আসেনি।
বেশির ভাগ মানুষই বাসায় বসে কাজ করছি আর চোখ সারাদিন ল্যাপটপের স্ক্রিনে। সারাক্ষণ তাকিয়ে রয়েছি সোসাল মিডিয়া বা টেলিভিশনের বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের দিকে। প্রতিদিনই জানার চেষ্টা, আজ কতোজন আক্রান্ত হলো, কতোজন মারা গেল এই শহরে আর নিজের মাতৃভুমি বাংলাদেশে। দেশের কথা খুব মনে পড়ে।আত্নীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই কেমন আছে?সবাই ভালো থাক,নিরাপদ থাক এটুকুই অন্তর থেকে চাওয়া।
পৃথিবীই আজ মৃত্যুযন্ত্রনায় কাতর।লাশের বহর আর আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।লাখের ঘর পার করেছে মৃতের সংখ্যা।কুড়ি লাখের দিকে ছুটছে আক্রান্তের হিসেব।গোটা পৃথিবীর মতোন আমরাও বিষাদগ্রস্হ। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করি তবু সুখবর আসেনা।কোথাও নিয়ন্ত্রনে আসেনা।ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিস্কার হয়নি এখনো। পৃথিবীর সকল শক্তি এক জীবানুর দাপটে অসহায়।তবু মানুষ লড়ছে। করোনার বিরুদ্ধে পৃথিবীর সব শক্তি ও মানুষ আজ এক মোহনায়।
আমাদের পরিচিতজনের মধ্যেও কেউ কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।পরিচিত একজন মারাও গেছেন। আগে কারও অসুখ বিসুখ হলে পরিচিত মানুষজন ছুটে আসতেন আর এখন কারও অসুখ বিসুখ হলে, দেখতে যাওয়ার উপায় নাই। কেউ মারা গেলে জানাজায় যাওয়ার উপায় নেই। ঘরে ঘরে শুধুই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা। কত অসহায় আমরা আর কত বেদনার অসুখ। কি অসহনীয় তার মর্মান্তিক মৃত্যু!
প্রচন্ড হতাশা নেমেছে।ভালোমতো ঘুমোতে পারছেন না। চরম মানসিক অস্থিরতা চলছে প্রিয়জনদের নিয়ে! দুশ্চিন্তা,সামনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে। এমন কঠিন সময় আমাদের জীবনে কখনো আসেনি। চার পাশে হতাশার ছবি। তবে এর মধ্যেও বেঁচে রয়েছে মানবতা। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন, সাহায্যর হাত বাডিয়ে দিয়েছেন । যে যার যায়গা থেকে চেষ্টা করছেন। এমনকি নিজের ঝুঁকি সত্ত্বেও অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কেউ কেউ!
সবকিছুর মধ্যেও সবার শুধু একটাই প্রশ্ন আর কতোদিন ? এর শেষ কবে ? তবে সব রাত্রিরই তো শেষ হয় -সকালের সূর্য ওঠে। তাই আমরাও অপেক্ষায় রয়েছি সেই সকালের ।আশাবাদী মানুষ আমরা।স্বপ্নই আমাদের শক্তি।মানুষের শক্তির বিজয অনিবার্য।জয় আসবেই ভোরের আলোতে,কেবল জানিনা রাতের আধারে কত জীবন ঝরে যাবে।
লেখক: সবিতা সোমানী,কানাডা প্রবাসী সাংস্কৃতিক সংগঠক,সমাজকর্মি