দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দুই ধাপ অবনতি হয়ে এবার দশম অবস্থানে বাংলাদেশ : টিআইবি
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দুই ধাপ অবনতি হয়ে এবার দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক-২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। যার মধ্যে হাইব্রিড গণতন্ত্র দেশে দুর্নীতি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
টিআই তাদের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। ১০০ স্কোরের মধ্যে গতবার বাংলাদেশ পেয়েছিল ২৫ পয়েন্ট, কিন্তু এবার ১ পয়েন্ট কমে পেয়েছ ২৪।
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর কার্যালয়ে এ তথ্য উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
এই অবনমন কারণ হিসেবে সংস্থাটি মনে করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণাসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার বাস্তবিক অর্থে কোনো কার্যকর প্রয়োগ হয়নি। বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরও অবনতি হয়েছে।
ড. জামান বলেন, সিপিআই-এ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় সিপিআই স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯; অথচ বাংলাদেশের স্কোর ২৪! এমনকি ফ্রিডম হাউজ অনুযায়ী যেসব দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র আছে এমন ৯৩টি রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৫৩ এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রসমূহের গড় স্কোর ৩১, সেখানেও বাংলাদেশের ২৪ স্কোর, উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর।
‘দুর্নীতি ও অবিচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; দুর্নীতি অন্যায়ের জন্ম দেয় এবং অন্যায় দুর্নীতির দুষ্ট চক্র তৈরি করে। সিপিআই-এর তথ্য আরও প্রমাণ করে, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত, সেসব দেশের কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বেশি। ’
সিপিআই উপস্থাপনায় বাংলাদেশের নিম্ন অবস্থানের ব্যাখ্যা তুলে ধরে ড. জামান বলেন, গত কয়েক বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’র সবচেয়ে আলোচিত মেয়াদ ছিল। কিন্তু এই মেয়াদে এই ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কৌশল-নির্ভর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি; উপরন্তু এই মেয়াদে দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
অর্থ পাচারের বিষয়ে তিনি বলেন, এ সময়কালে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে আসলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। ঋণ খেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থপাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি, বরং এর জন্য যারা দায়ী তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কার্যকর দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি।
অনেক উন্নত দেশেও দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। এই বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অবনমন হচ্ছে, স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা কমছে। বিচার ব্যবস্থা ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে, ফলে জবাবদিহির সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। দুর্নীতির গভীরতা বাড়ছে এবং যারা দুর্নীতি করছে তারা বিচারহীনতা ভোগ করছে।
টিআইবি বলছে, দুদক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কার্যকর প্রয়োগ করতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক নিজেদের সক্ষমতার ব্যবহার করতে পারেনি।
পরিস্থিতি বদলানোর সম্ভাবনা দেখেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে টিআই কথা বলে, গণমাধ্যম বলে, সরকারও বলে। নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো কথা বলা হয়। ইশতেহার কাগজে–কলমেই থেকে যায়, দলগুলো ফিরেও তাকায় না। এবারও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জনস্বার্থে কাজ করবেন। আমরা আস্থা রাখতে চাই।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, যখন দুর্নীতি, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলি, তখন তারা ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। সরকারের লোকজন এমনভাবে কথা বলেন, সবাই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটা কথা বললে সেটাকে স্বীকৃতি দিয়ে দুর্নীতিকে কমানোর মানসিকতা নিয়ে তারা কাজ করেন না।