যেভাবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলছে সংঘবদ্ধ প্রচারণা
ইংরেজিতে ‘স্মিয়ার ক্যাম্পেইন’ (smear campaign) বলতে একটি কথা আছে। বাংলায় এককথায় এটিকে বুঝানোর মতো শব্দ জানা নেই। মূলত কোনো ব্যক্তির গায়ে কলঙ্কলেপনের উদ্দেশ্যে যে প্রচারণা চালানো হয় সেটিকে স্মিয়ার ক্যাম্পেইন বলে।
গত ২৭শে আগস্ট বিশ্বের ১৬০ জন নোবেল বিজয়ী এবং নেতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে একটি বিবৃতি দেন। তাতে তারা বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে, সম্প্রতি তাকে (ড. ইউনূস) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে এবং এটি ধারাবাহিকভাবে বিচারিক হেনস্তা বলে আমরা মনে করি।’
তারা ইউনূস প্রসঙ্গে আরও বলেন, “আমরা সম্মানের সঙ্গে অনুরোধ করছি, অবিলম্বে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করুন, এরপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে আপনার দেশের নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেলে এই অভিযোগ পর্যালোচনা করুন। আমরা নিশ্চিত যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী এবং শ্রম আইনে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা হলে তিনি খালাস পাবেন।”
বিবৃতিদাতারা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “বাংলাদেশে সম্প্রতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখছি, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনকালীন প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের ২টি জাতীয় নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতার অভাব ছিল।”
এই বিবৃতির খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্মিয়ার ক্যাম্পেইন বা কুৎসা রটানো শুরু হয়েছে। সেই কুৎসাগুলো কেমন তার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
“সমকামী মন্ত্রীকে বন্ধুর সঙ্গে ডেট করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন হিলারি। সেই বন্ধুটি কি সমকামী ইউনুস?”- এটি Bangla Politix নামক একটি ফেসবুক পেইজের গতকালের একটি পোস্টের ক্যাপশন।
https://archive.ph/V1FOe
সমকামিতা বাংলাদেশের সমাজে ট্যাবু এবং আইনত নিষিদ্ধ একটি কাজ। কিন্তু এই কাজটি পশ্চিমা বিভিন্ন সমাজে বৈধ এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক বিষয়।
সম্প্রতি বিবিসি রেডিও ওয়েলসের একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়েলসের শিক্ষামন্ত্রী জেরেমি মাইলস জানান, মাইলস সমকামী (গে) বলে জানার পর হিলারি তাঁকে নিজের এক সমকামী বন্ধুর সঙ্গে ডেট করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
জেরেমি মাইলস অভিযোগ আকারে নয়, বরং প্রশংসাসূচকভাবেই হিলারির ব্যাপারে এই তথ্যটি দিয়েছিলেন। তো এই খবরের স্ক্রিনশটের সাথে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ড. ইউনূসের ছবি যুক্ত করে তাকে ‘সমকামী ইউনূস’ বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে সমকামিতার ব্যাপারে বাংলাদেশের সমাজে বিদ্যমান ট্যাবুকে ড. ইউনূসের সাথে জড়িয়ে তাকে ‘খারাপ’ হিসেবে দেখানোই উদ্দেশ্য। ফেসবুকে অন্তত ১৬টি পেইজ থেকে একই ক্যাপশনে এই ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে।
আরেকটি পোস্টের ক্যাপশন হচ্ছে, “সুদের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় লাশ দাফন করতে দেয়নি ড. ইউনূস”। কিন্তু কবে কোথায় কার লাশ ড. ইউনূস দাফন করতে দেননি তার কোন বিস্তারিত তথ্য নেই। ইন্টারনেটে খোঁজ করেও এমন কোন খবরের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
https://archive.ph/NORwj
“দেশদ্রোহী সুদখোর ইউনুস দুমুখো সাপ, মুখে মধু অন্তরে বিষ”- এই ক্যাপশনে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে একাধিক পেইজ এবং একাউন্ট থেকে।
https://archive.ph/uIsMn
“ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের পদে রাখতে যেভাবে হিলারি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছে”- এই ক্যাপশনের একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে অন্তত ১০৪টি ফেসবুক পেইজ এবং একাউন্ট থেকে। যদিও ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে অতীতে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, পদ্ম সেতুর অর্থায়ন বন্ধে তার কোন ভূমিকা ছিলো না।
https://archive.ph/OYeRx
একটি ফেসবুক পোস্টে একটি ভিডিও ক্যাপশন লেখা হয়েছে, “ড. ইউনুস একজন পাক্কা সুদখোর। সে শুধু নিজেই সুদখোর তা নয় বরং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরে ঘরে সুদ নামক নিকৃষ্ট হারামটি তারই মাধ্যমে পৌঁছেছিল।” ক্যাপশনটি খুবই মজার এই কারণে যে, এটি পড়লে মনে হবে বাংলাদেশে একমাত্র ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক ‘সুদের কারবার’ করে থাকে! আর বাকি যেসব ব্যাংক রয়েছে সেগুলো ‘সুদ নামক নিকৃষ্ট হারামটি’ থেকে মুক্ত আছে!
https://archive.ph/4S7Dc
এভাবে আরও নানান ধরনের অসত্য, অযাচাইকৃত তথ্য এবং আপত্তিকর অভিধায় ড. ইউনূসকে অভিহিত করে শত শত পোস্ট করা হয়েছে। ফেসবুকে ক্রাউড ট্যাঙ্গল টুলে শুধু ‘সুদখোর ইউনুস’ লিখে সার্চ করে গত এক মাসের মধ্যে ১২৬টি পোস্ট পাওয়া গেছে যার বেশিরভাগই গত ৩দিনে পোস্ট করা। যেসব পেইজ এবং প্রোফাইল থেকে এসব পোস্ট করা হচ্ছে সেগুলো নিয়মিতভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক দল বা ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রচারণা করে থাকে।
এর বাইরে আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে ড. ইউনূসকে নিয়ে যারা ইতিবাচকভাবে ফেসবুকে লিখেছেন তাদের পোস্টে। ড. ইউনুসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে সাধারণত যেসব পোস্ট করা হয়ে থাকে সেগুলোতে মানুষের রিয়েকশন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘লাইক’ এবং ‘লাভ’ রিয়েকশনের সংখ্যা বেশি থাকে। আমি এই পেইজের সর্বশেষ ২০টি পোস্ট পর্যবেক্ষণ করে তাই পেলাম।
কিন্তু গতকাল (৩০ আগস্ট) ড. ইউনুসের পেইজে যে ৫টি পোস্ট করা হয়েছে তার প্রথম ৩টিতে দেখা যাচ্ছে মোট রিয়েকশনের মধ্যে ‘হাহা’ বিজয়ী হয়েছে! ইউনূসের পক্ষে এবিসি এর একটি রিপোর্টের স্ক্রিনশট সম্বলিত পোস্টে মোট ২৯০০ এর বেশি রিয়েকশনের মধ্যে ২২০০ এর মতো হাহা (৩০ আগস্ট বিকাল পর্যন্ত) । ভারতীয় দ্য ওয়্যার এর একটি রিপোর্টের স্ক্রিনশট সম্বলিত পোস্টে মোট ৩৫০০ এর বেশি রিয়েকশনের মধ্যে ২৩০০ এর মতো হাহা। এবং ইউনূসকে নিয়ে মানবজমিনের একটি রিপোর্টের স্ক্রিনশট সম্বলিত পোস্টে মোট ৫৪০০ এর বেশি রিয়েকশনের মধ্যে ২৪০০ এর মতো হাহা।
ড. ইউনূসের পেইজের পোস্টগুলোতে পাবলিক রিয়েকশনের ক্ষেত্রে এটি খুবই ভিন্নরকম ঘটনা।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ‘হাহা’যুদ্ধ চলছে। কারা কোন ধরনের খবর/পোস্টে হাহা দিচ্ছেন তা নিয়ে অনেক আলোচনাও চলছে। কেউ কেউ এই ‘হাহা’কে ভিন্নমত প্রকাশের উপায় হিসেবেও দেখছেন। কারো সাথে দ্বিমত করলে বা কাউকে অপছন্দ করলে বা ব্যঙ্গ করার জন্য এখন ফেসবুকে ‘হাহা’ এর প্রয়োগ হচ্ছে। কোন পোস্টে হাহা এর সংখ্যা গুণে ওই পোস্টটি মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হলো তারও বিচার বিশ্লেষণ অনেকে করে থাকেন।
তো, ইউনূসের পেইজের সর্বশেষ পোস্টগুলোতে হাহা এর সংখ্যা বেশি হওয়ার ব্যাপারটিকেও কেউ কেউ তার ‘গ্রহণযোগ্যতা না থাকার প্রমাণ’ হিসেবে দেখার প্রয়াস পেতে পারেন।
কিন্তু মজার বিষয় হলো, ড. ইউনুসের পেইজের সর্বশেষ ৫টির মধ্যে প্রথম ৩টি পোস্টে ‘হাহা’ এর বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে ঘটেনি। অর্থাৎ, সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী মানুষেরা এসব রিয়েকশন দেননি, বরং হাহা রিয়েকশন দেয়া হয়েছে শত শত বট একাউন্ট থেকে। বট একাউন্ট হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে নানান কার্যক্রম চালানোর কৃত্রিম ব্যবস্থা। কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে অটো জেনারেটেড অসংখ্য ভুয়া একাউন্ট দিয়ে সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন আচরণ (লাইক/শেয়ার/কমেন্ট) করানো।
বট একাউন্টের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে- যেমন এদের একাউন্টের মালিককে চিহ্নিত করার মতো যথেষ্ট তথ্য থাকবে না, এদের ফলোয়ার বা ফ্রেন্ড এর সংখ্যা খুবই কম হবে, এদের ফেসবুক ওয়াল হয়তো লক করা থাকবে অথবা তেমন কোন এক্টিভিটি থাকবে না, ফেসবুক এসব প্রোফাইলে ‘নতুন একাউন্ট’ বলে একটি নোটিশ দিয়ে রাখে, এরা একসাথে একই রকম কাজ করে।
ড. ইউনূসের যে ৩টি পোস্টে হাহা রিয়েকশন বেশি পড়েছে সেগুলোতে হাহা দেয়া কয়েকশ একাউন্ট চেক করে উপরের সব বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া এসব একাউন্টের বেশিরভাগের নাম অবাঙালি। কিছু নাম হিন্দি, আরবি, পর্তুগিজ ভাষার। অনেকগুলো বট প্রোফাইলে ক্লিক করে তাদের ঠিকানা হিসেবে যেসব দেশের নাম পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে: ভারত, ব্রাজিল, পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা, মিশর, মরোক্কো, থাইল্যান্ড, পেরু, আইভোরি কোস্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া, নিকারাগুয়া, মালাওয়ী, ইয়েমেন ইত্যাদি।
কিছু বট একাউন্টের নাম এরকম: Lyliya Handa, Amoiyao Evariste, Chalos Lubelo, Ghasi Ram Balai, Khirasindhu Putel, Allo Allo, मुनटु मुनटु, Wedesen Feleke, Laizer Lizzer, Vaithlingam N ইত্যাদি।
এই একই ঘটনা ঘটেছে হিলারি ক্লিনটনের ফেসবুক পোস্টে। তিনি গতকাল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে ড. ইউনূসকে নিয়ে দেয়া বিবৃতিটি শেয়ার করেন। সেখানে আজ বিকাল পর্যন্ত ১৪ হাজারের মতো রিয়েকশন পড়েছে যার মধ্যে ৭ হাজার ‘হাহা’। এবং এই হাহা রিয়েকশনদাতা বেশিরভাগ প্রোফাইলই ‘বট একাউন্ট’ এর বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এই বটেরা সমানতালে কমেন্টও করে যাচ্ছে ড. ইউনূসের বিপক্ষে।
————-
লেখক: ফ্যাক্ট চেক এডিটর, এএফপি