পবিত্র মাহে রমজানের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ততই বাড়ছে
পবিত্র মাহে রমজানের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ততই বাড়ছে। ইতোমধ্যে চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা ও মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে।
৮৫ টাকা কেজির ছোলা ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি চিনির দাম সর্বোচ্চ ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। কারও যেন কিছুই করার নেই। এতে নিত্যপণ্য কিনতে মাসের নির্ধারিত খরচ সপ্তাহই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে শুধু খাবারের বাজেট কাটছাঁট করছেন। তাই টানাটানির সংসারে রোজা ঘিরে ভোক্তার মনে নতুন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, প্রতি বছরের মতো এবারও রোজায় বাড়তি মূল্যে পণ্য কিনতে হবে। শনিবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
কয়েক দিন আগেই গরুর মাংসের কেজি ৫৫০-৬০০ টাকা হলেও ফের ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির কেজিও ২০০ টাকা। অন্যান্য মুরগি কিনতে কেজিপ্রতি ২৮০-৫৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে। আর গরিবের মাছ- তেলাপিয়া ও পাঙাশ চলে গেছে নাগালের বাইরে। তাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকে এখন সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না। এজন্য বাজার করা এখন বড় ধরনের মানসিক কষ্ট ও হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়তি সবজির দামও।
এ পরিস্থিতিতে রোজার বাজার সামাল দিতে সরকার আরও সক্রিয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতোমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ে সরকারের অনেক সংস্থা মাঠে নেমেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক মনিটরিং টিম। পাশাপাশি এই কার্যক্রমে জেলা প্রশাসন, মৎস্য কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি এবং ক্যাব সদস্যরাও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন।
তবে সরকারের পদক্ষেপের পরও পণ্যের দাম না কমায় ভোক্তা পর্যায়ে শঙ্কা কাটছে না। কেননা প্রতিবছরই একটি চক্র রমজানকে টার্গেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের পকেট কাটে। ইতোমধ্যে বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা শুরু হয়েছে। বেশি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বরে প্রতিকেজি চিনি ১৩৫ টাকা বিক্রি হলেও চলতি বছর জানুয়ারিতে ১৪৫-১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিকেজি ভালো মানের মসুর ডাল নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা, জানুয়ারিতে ১৪০ টাকা। প্রতিকেজি ছোলা নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। জানুয়ারিতে দাম বেড়ে ১০০-১১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা, জানুয়ারিতে দাম বেড়ে ১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের মধ্যে নভেম্বরে প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ১৬৮ টাকা, জানুয়ারিতে বিক্রি হয়েছে ১৭২-১৭৩ টাকা। পাম সুপার প্রতিলিটার নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকা, জানুয়ারিতে আরেক ধাপ বেড়ে ১৪২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নভেম্বরে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১৩০ টাকা বিক্রি হলেও ডিসেম্বরে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। তবে দেশিজাত বাজারে আসায় দাম কিছুটা কমে রোববার পর্যন্ত ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হলেও বুধবার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা।
এদিকে গত বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ৫৯৫ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে। ফলে ভোক্তা অধিদপ্তর থেকেও মাংসের দাম সহনীয় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে কম দামে পাওয়ায় অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ মাংস কিনতে পারে। কিন্তু ফের কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে গরুর মাংস। বুধবার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৭৫০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা। প্রতিকেজি লেয়ারে মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। আর দেশি মুরগি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা।
এছাড়া সবজির ভড়া মৌসুমেও মাঝারি আকারের প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা। করলা প্রতিকেজি ৯০-১০০ টাকা। প্রতিকেজি কাঁচামরিচ ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিকেজি ধুন্দলের দাম ১০ টাকা বেড়ে ৮০-৯০ টাকা হয়েছে। আলুর কেজি ৫৫-৬৫ টাকা, প্রতি কেজি বেগুন ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর বড় আকারের প্রতিপিস লাউ ১০০ টাকার বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে টমেটোর কেজি রাখা হচ্ছে ৬০-৯০ টাকা। শিম কিনতে ক্রেতার কেজিপ্রতি খরচ হচ্ছে ৭০-৯০ টাকা। আর শিমের বিচি বিক্রি হচ্ছে কেজি ২০০ টাকা। প্রতিকেজি তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা। চাষের কই প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৮০ টাকা, শিং মাছ ৫০০ টাকা, ছোট সাইজের শোল মাছ ৫০০ টাকা ও আর মাঝারি সাইজের শোল ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সরপুঁটি প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৮০ টাকায়।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা ভ্যান চালক বলেন, বাসায় আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। সঙ্গে স্ত্রী ও মাসহ আমরা পরিবারে মোট পাঁচজন। ভ্যান চালিয়ে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোনোদিন আয় হয় না। এই আয় দিয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কী রেখে কী কিনব, সেটা ভেবে পাচ্ছি না। চাল কিনলে ডালের টাকা থাকছে না। তেল কিনলে সবজির টাকা থাকছে না।
মালিবাগ কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা । তিনি বলেন, আমি মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পাই। তা দিয়ে পরিবারের ছয় সদস্যের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মাসের বাজারের খরচ সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই খেয়ে বেঁচে থাকতে অল্প পরিমাণে পণ্য কিনতে হচ্ছে।
নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা বলেন, কিছু সিন্ডিকেটের হাতে পুরো দেশ জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ধনীদের কোনো সমস্যা না হলেও গরিব মানুষ খুব কষ্টে আছে। কারণ আমি বিক্রেতা, আমি দেখি যিনি আগে এক কেজি পণ্য কিনতেন, তিনি এখন আধা কেজি কিনছেন। আর ধনীরা পণ্যের লিস্ট দিয়ে বাজার করছেন।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিবছর একই প্রক্রিয়ায় মূল্য কারসাজি করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছেন। তবে এর কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে তদারকি সংস্থাগুলোর কোনো গবেষণা নেই। নেই কোনো বাজার তদারকির পরিকল্পনা। ফলে বছরের পর বছর সেই চেনা মুখ বাজারে ভোক্তার অস্বস্তি বাড়ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রমজানকে পুঁজি করে কেউ যাতে অতি মুনাফা করে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে সেজন্য সরকারের তদারকি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এ সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে বাজার কমিটি বাতিলসহ অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে। এমনকি প্রয়োজনে জেলে পাঠানো হতে পারে।