ঋণ নিয়ে একের পর এক বড় অবকাঠামো হচ্ছে- কিন্তু মানবসম্পদের উন্নয়ন হচ্ছে না : সাবেক অর্থ উপদেষ্টা

0
image-713762-1693672226
Array

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বড় অবকাঠামো হলেই একটি দেশের উন্নয়ন হয় না। ঋণ নিয়ে একের পর এক বড় অবকাঠামো হচ্ছে- কিন্তু মানবসম্পদের উন্নয়ন হচ্ছে না। এতে রক্ত-মাংস কিছুই থাকে না। এটি অর্থনীতির জন্য কঙ্কাল। ঋণ নিয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা জায়গায় থামতে হবে। ১০০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের মধ্যে ৫০ বিলিয়নই গত তিন বছরে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এর আগে ভবিষ্যতের দিক না তাকিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে এর মাশুল (মূল্য) দিতে হচ্ছে।
শনিবার রাজধানীর পল্টন টাওয়ারে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে কুটনীতির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কৌশল ও ভূরাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে দলনিরপেক্ষ চিন্তা হওয়া উচিত। দলীয় স্বার্থ ও দেশের স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলে তা দেশের জন্য সুখকর নয়। তিনি বলেন, কোনো দেশ আমাকে সমর্থন করল, সেজন্য আমি তার পক্ষে চলে যাব- এটি দেশের জন্য অত্যন্ত শঙ্কার। তিনি বলেন, অপ্রিয় সত্য কথা বলা অর্থনীতিবিদদের সরকার পছন্দ করে না। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইআরএফের সভাপতি রিফায়েত উল্লাহ মীরধা এবং সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের চলমান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি এবং অর্থ পাচার। এ সমস্যাগুলো নিয়ে আমি গত বছরও কথা বলেছিলাম। এ বছর তা আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি, এ সমস্যার অন্যতম কারণ হলো- আগে থেকে আমরা কিছু ভুল করেছিলাম। বর্তমানে তার প্রভাব পড়ছে।

তিনি বলেন, অন্য দেশের তুলনায় আমরা আগে অনেক ভালো করছিলাম। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। সামগ্রিক অর্থনীতি, বৈদেশিক লেনদেন এবং বাজেটসহ সবকিছুর ভারসাম্য ভালো অবস্থায় ছিল। এ বেশি ভালো থেকেই কিছু ভুল করে ফেলেছি। ডলারের দাম অনেক দিন ধরে সমন্বয় করা হয়নি। ওই সময়ে ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশ ব্যাংক আরও ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল নামে ব্যবসায়ীদের টাকা দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতকে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। একের পর এক হাতে নেওয়া হয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প। এখানে অনেক ভুল হয়েছে। কারণ যখন বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে তখন ডলারের দাম ছিল কম। এখন বেড়ে গেছে। এ ছাড়া যেসব প্রভাবশালী দেশের ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করে না, সেই ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করবে- এটি কীভাবে ভাবলাম। বর্তমানে এসব বিদেশি ঋণ, খেলাপি হয়ে গেছে। এতে বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, যত ইচ্ছা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছিল। বিবেচনা ছিল- আমাদের তো যথেষ্ট রিজার্ভ আছে। কোনো অসুবিধা হবে না। ভবিষ্যতে হঠাৎ করে কোনো চাপ আসতে পারে- সেটা চিন্তায় ছিল না।

রিজার্ভ প্রসঙ্গে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এর মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে জানানো হয়- আমাদের অর্থনীতির শক্তি আছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। এটা নিজেদের ব্যবহারের জন্য নয়। তবে আপদের সময়ে কাজে লাগে।

তিনি বলেন, আমরা একের পর এক বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প করে যাচ্ছি। এগুলো ঋণের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক আছে প্রয়োজনীয়। অনেকগুলো আবার প্রয়োজন ছিল না। গত তিন বছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে আমাদের এ ঋণ ফেরত দিতে হবে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার করে। ভবিষ্যতে আমরা আরও ঋণ নিলে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এজন্য লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে আমাদের বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিতে হবে। শুধু অবকাঠামো বানিয়ে পৃথিবীতে কোনো দেশ উন্নত হয়নি। একের পর এক বড় প্রকল্প বানাতে থাকলাম। কিন্তু একটি জায়গায় থামতে হবে। আর থামার জন্য হিসাব করতে হবে- কত টাকায় প্রকল্প বানালাম। বড় অবকাঠামো থাকলে মানুষের চলাচলের সুবিধা হয়। জাতীয় সম্মানেরও (প্রেস্টিজ) ব্যাপার। এ কারণে এগুলোকে প্রেস্টিজ প্রকল্প বলা হয়।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা উচ্ছ্বসিত হই, গর্ববোধ করি। কিন্তু এটুকু এত বড় প্রকল্পের সুফল হলে উন্নয়ন অনেক সহজ হতো। তিনি বলেন, এ প্রকল্প ঋণ অথবা নিজেদের টাকায় হোক- এ অর্থ খরচের উদ্দেশ্য হলো বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা। প্রকল্পের কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে। যাতায়াতসহ সবকিছুতে খরচ কমবে। শিল্প হবে রপ্তানিমুখী। কিন্তু সেটি কি হয়েছে? ভিয়েতনামে প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসে। বাংলাদেশে আসে ১ বিলিয়ন। বিদেশিরা বলেন- বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনেক সমস্যা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। কোনো কিছু অনুমোদন পেতে অনেক সময় লাগে। আরও অনেক সমস্যা আছে।

তিনি বলেন, একটির পর একটি অবকাঠামো বানাচ্ছি, একটি শেষ হলে আর দুইটি অনুমোদন দিচ্ছি। কিন্তু অবশ্যই এক জায়গায় থামা উচিত। কারণ এ ঋণ একসময় পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া বড় অবকাঠামোর আগে ভবিষ্যতের জন্য স্পষ্ট রোডম্যাপ থাকতে হয়।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুল, ব্রিজ অথবা এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ শীর্ষ ৫০ থেকে ১০০টি বড় প্রকল্পের মধ্যে ১০ থেকে ১২টি চীন ও জাপানে। বাকিগুলো উন্নয়নশীল দেশে। কিন্তু বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটাও এসব দেশে নেই। বর্তমানে চীন বুঝতে পেরেছে শুধু অবকাঠামো দিয়ে উন্নয়ন হয় না। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, হংকং ও পশ্চিমাদের সহায়তায় বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। অবকাঠামো যদি মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে না মেলে, তাহলে এ অকাঠামো হলো অর্থনীতির কঙ্কাল। আর এর রক্ত মাংস হলো মানবসম্পদ। যদি মনে করি, শিক্ষার পরিবেশ যা আছে তাই থাকুক, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে থাকব। প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং র‌্যাংকিং কোথায় আছে- সেটি বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষা মানসম্মত না হলে সেটি ভয়ের ব্যাপার।

তিনি বলেন, চীন ও ভিয়েতনামের তুলনা করা হয়। সেখানে উচ্চশিক্ষায় ২০ শতাংশ চলে পলিটেকনিকে। এরপর নার্সিংয়ে। সেখানে সাধারণ শিক্ষা একেবারেই কম। অর্থাৎ মানবসম্পদের সঙ্গে ভৌত অবকাঠামোর একটা যোগাযোগ রাখতে হবে।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, দেশীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলকে একই প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। সাপ্লাইচেনের ক্ষেত্রে আমরা যে জায়গায় আছি, সেখানে আমাদের উন্নত দেশ তো দরকার এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে চীনকে দরকার। সবার সঙ্গে ভারসাম্য রাখা আমাদের জাতীয় নীতি হওয়া উচিত। যেকোনোভাবেই আমাদের ভারসাম্য রাখতে হবে। আমরা আফ্রিকার মতো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ালে হবে না। কারণ আমরা যেসব পণ্য বিক্রি করব সেগুলো পশ্চিমা দেশে। আমাদের বেশির ভাগ পণ্য ওই দেশে রপ্তানি হয়। ইতোমধ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা হারিয়ে ফেলেছি। এতে দেশটিতে আমাদের রপ্তানি কমেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, সম্প্রতি আলোচনায় আরেকটি নতুন জিনিস এসেছে- তা হলো আমরা দেউলিয়া হয়ে যাব কিনা। আগে এটি আফ্রিকাতে ছিল। এখন বাংলাদেশে এসেছে। এর কারণ হলো- ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, শ্রীলংকা দেউলিয়া হওয়ার পর অনেকে বলেন, আমরা দেউলিয়া হব না। আর দেউলিয়া না হওয়াকে বিরাট অর্জন হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু এটি অর্থনীতির বিষয় ছিল না। অর্থনীতির বিষয় ছিল- কত বিনিয়োগ করে, কত সাশ্রয় করে কত উন্নয়ন হতে পারে।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আরেক বড় সমস্যা হলো অর্থ পাচার। পুঁজি পাচার হচ্ছে, বেগমপাড়ায় যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের চেইন হোটেলে বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করছে। ডামি কোম্পানি তৈরি করে অর্থ পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, অনিশ্চয়তায় অর্থ পাচার বাড়ে। বৈধ আয় হলেও দেশের ওপর আস্থা না থাকলে অর্থ পাচার হয়।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে গেছে। কেউ তো এ অর্থ ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি। ব্যাংকিং সিস্টেমে পাচার হয়েছে। কিন্তু সবকিছু ডিজিটাল হলেও তা ধরা যায়নি। নিজের ব্যাংক থাকলে কেউ বেসামালভাবে নিয়ে যান। তাকে ধরা হয় না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, অপ্রিয় সত্য কথা বলা অর্থনীতিবিদদের সরকার পছন্দ করে না। বাংলাদেশে চারজন অর্থনীতিবিদকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই তাদের যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমার মতো অর্থনীতিবিদকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কারণ হলো- সমালোচনা মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা আমাদের গড়ে ওঠেনি। এটি আমাদের কালচারে নেই।

About Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat