সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে অবশেষে সংকট কাটলো বোতলজাত সয়াবিন তেলের

দেড় মাসেরও বেশি সময় পর সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়েছে। এতে ভোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরেছে। ব্যবসায়িকরা বলছেন, পুরোপুরি সংকট না কাটলেও গত দুই দিনে বোতলের সয়াবিন তেলের সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আশা করা যায়, ২-১ দিনের মধ্যে সংকট পুরোপুরি কেটে যাবে।
বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজার, নয়াবাজার, হাতিরপুল ও মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবসায়িক ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
কারওয়ান বাজারে দুই শতাধিক দোকানে ভোজ্যতেল বিক্রি করা হয়। বুধবার বিকেলে বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায় আগের তুলনায় ২ দিনে সরবরাহ অনেক বেড়েছে।
ব্যবসায়িক বিধান সাহা বলেন, এখন আর বোতলের সয়াবিন তেলের সংকট নেই। চাহিদামতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। তবে রমজানের শুরুতে সয়াবিন নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি আরো বলেন, এখন তো এমনিতেই সয়াবিন তেলের চাহিদা কমেছে।
কারওয়ান বাজারের হাজী মিজান ট্রেডার্সের সাগর হোসেন বলেন, গত দুইদিন ধরে সয়াবিনের কোনো সংকট নেই। ২ দিনে সরবরাহ অনেক বেড়েছে।
মেসার্স আল-আমিন টেডার্সের আজগর হোসেন বলেন, রোজার শুরুতে যে ধরনের সংকট ছিল তা গত দুইদিনে কেটে গেছে। এখন আমরা চাহিদা মতই সরবরাহ পাচ্ছি।
তবে আল্লাহর দান স্টোরের মালিক ওমর ফারুক বলেন, এখনো পুরোপুরি সংকট কাটেনি। ১/২ লিটারের সয়াবিনের বোতল পাওয়া গেলেও ৫ লিটারের বোতল এখনো চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে না। আজকেও অর্ডার করেও ৫ লিটারের বোতল পাইনি। তার মতে, বাজারে বড় ধরনের সিন্ডিকেট সক্রিয়। এ বিষয়ে সরকারের আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে আমেনা খাতুন নামের এক ক্রেতারা কারওয়ান বাজার থেকে ৫লিটারের সয়াবিনের বোতল নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। তিনি বলেন, সব দোকানেই এখন সয়াবিনের বোতল পাওয়া যাচ্ছে।
গত ১০ ডিসেম্বর ব্যবসায়িকদের চাপের মুখে লিটারে আট টাকা বাড়ানোর পর কয়েকদিন সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পর ফের বাজারে বোতলজাত ভোজ্যতেলের সংকট সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল হঠাৎ উদাও হয়ে যায়। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে এ ধরনের সংকট চলার পর সরকারের কঠোর অবস্থানে অবশেষে বোতলজাত সয়াবিনের সংকট কেটেছে।
ডিলাররা বলছেন সব প্রতিষ্ঠান সময়মতো সয়াবিন তেল সরবরাহ না করায় এই সংকট তৈরি হয়েছিল। ভোক্তারা বলছেন, সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে না পারলে আবারো সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়তে পারে।
ভোগ্যপণ্যের সরবরাহকারি নাবিল গ্রুপের কর্ণধার আমিনুল ইসলাম স্বপন বলেন, রমজানের আগ মুহূর্তে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের যে সংকট হয় তা ছিল কৃত্রিম। যারা এর আগে ৬০-৭০ শতাংশ ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো তারাই মূলত তেলের মিল বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির ক্ষেত্রে জড়িত। সেহেতু সরকারকে প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথা বারবার এ ধরনের সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে রোজায় ভোজ্যতেলের চাহিদা তিন লাখ টন। সেই তুলনায় এবার আমদানি বেশি হলেও সরবরাহ হয়নি। এছাড়া শুল্ক-কর কমানোর পরও সংকট তৈরি হয়। বাজারে সংকট থাকলেও বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানির তথ্য রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ১ লাখ ১৭ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে, যা গত ছয় বছরে মাসিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ । তবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ২০ দিনে মাত্র এক জাহাজ সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছিল। আমদানি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা না থাকায় সয়াবিন তেলের সংকট তীব্র হয়। তবে রোজার আগমুহূর্তে সয়াবিন তেল নিয়ে একের পর এক ট্যাংকার বন্দরে এসে পৌঁছায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, টি কে, এমজিআই ও সিটি গ্রুপের সূত্রে জানা গেছে, সব মিলিয়ে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে টি কে গ্রুপের ৪৩ হাজার টন, এমজিআইয়ের ৫০ হাজার টন এবং সিটি গ্রুপের ২৬ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি করেছে। এর বাইরে অন্যান্য কোম্পানির ১১ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানির হিসাব পাওয়া গেছে।
দেশে আগামী ২ মার্চ রোজা শুরু হয়। এর আগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঁচ ট্যাংকারে আমদানি হয় ৭৮ হাজার টন বা সাড়ে ৮ কোটি লিটার সয়াবিন তেল। আর রোজা শুরুর প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৪ ট্যাংকারে আরও ৫১ হাজার টন সয়াবিন তেল আসে। অর্থাৎ রোজার এক সপ্তাহের মধ্যেই ১ লাখ ২৯ হাজার টন বা প্রায় ১৪ কোটি লিটার সয়াবিন তেল আমদানি হয়। চট্টগ্রাম বন্দর ও আমদানিকারকদের সূত্রে আমদানির এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেল ৫ লাখ ৯৮ হাজার টন আনার ঋণপত্র নিষ্পত্তি করেন। অথচ গত রমজানের একই সময়ে (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি) ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেল ৪ লাখ ৪৭ হাজার টন আনতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি করেছিলেন। এই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার সয়াবিন তেলের আমদানি বেড়েছে ।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভোগ্যপণ্য যে হারে আমদানি হয়েছে, মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকায় খুচরা বাজারে ভোক্তারা সুফল সেভাবে পাচ্ছেন না। প্রশাসনের নজরদারি আরও জোরদার করা দরকার।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযানের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর সয়াবিনের সরবরাহ বাড়তে থাকে। চট্টগ্রামের বাজারে ভোজ্য তেলের দীর্ঘদিনের সংকট ও সরবরাহে কোনো উন্নতি না হওয়ায় জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ব্যবসায়ীদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। টানা চার দফা বৈঠকের পরও কার্যকর সমাধান না আসায় তিনি কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেন। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, এবার আমি দেখতে চাই রাষ্ট্রের শক্তি বেশি না ব্যবসায়ীদের। যদি তেলের সরবরাহ যথাযথ না হয়, তবে গুদামগুলোতে অভিযান চালানো হবে। প্রশাসনের এমন কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট কাটতে শুরু করেছে।