প্রশাসনে অস্থিরতা, কাজে স্থবিরতা

0
-e17fe87764fbb0060a67dde9b501e8ca
Array

আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে ১২ দিন হলো আজ। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ৯ দিন হলো। তবে এখনও অস্থিরতা কাজ চলছে সরকারের প্রশাসনে। থমকে আছে সরকারি কাকজর্ম। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ক্ষোভ, বিক্ষোভ, হানাহানি প্রকাশ্যে এসেছে। উপজেলা প্রশাসন, জেলা, বিভাগসহ সচিবালয় পর্যন্ত সবখানে অস্থিরতা দৃশ্যমান।

বিদ্যমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের শেখ হাসিনা সরকারের ‘দালাল’ আখ্যা দিচ্ছেন দীর্ঘদিনের পদবঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকার পালাবদলের এই সময়টায় তাদের অনেকে ব্যস্ত ‘ফায়দা লুটতে’। মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি এখনও শীর্ষ পদে থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের কাজে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করছেন। বিক্ষোভকারীদের ভাষ্যমতে এখন চলছে ‘শুদ্ধি অভিযান’। এতে সরকারি অনেক কাজে যেমন স্থবিরতা এসেছে, সাধারণ মানুষ বা সেবাগ্রহীতারা বিভিন্ন নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সচিবালয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা প্রশাসনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হানাহানি, মারামারি, সহিংসতা, প্রতিশোধ, পদ-দখল, লুটতরাজ থেকে বাদ যায়নি প্রশাসনও। যোগ্যতা থাক আর না থাক, মনের মতো পদ না পাওয়া সচিব থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার-সুইপার পর্যন্ত সবাই এখন আগের সরকারের ‘বৈষম্যের স্বীকার’ বলে দাবি করছেন। নিজের কাজ বাদ দেয়ে ঊর্ধ্বতন পদে বিদ্যমানদের সরিয়ে নিজেদের পদায়নের দাবি করছেন তারা। এসব দাবি ও বিক্ষোভের মুখে অনেকেই পদ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন স্বেচ্ছায়, আবার কাউকে কাউকে পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে ভয়ভীতি দেখিয়ে। যারা আছেন তারা ভুগছেন নানা ধরনের শঙ্কায়, কখন বুঝি তাদের সরিয়ে দেয় বা সরে যেতে হয়।

ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও দাবি তোলা হয়েছে, বিগত সরকারের সময় যারা প্রশাসনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বা যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের।

ছাত্রদের দাবির মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন দেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি। এর আগেই পদত্যাগ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পর সরিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের আইজি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে। পদত্যাগ করেছেন বিভিন্ন সরকারি দফতর, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অনেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একদল কর্মকর্তা কর্মচারীদের দাবির মুখে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এর আগে পদত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর।

সম্প্রতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন থেকেই তাদের পদত্যাগের দাবিতে সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে নিজের কাজ বাদ দিয়ে বিক্ষোভে নেমেছিল এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিক্ষোভের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ থেকে সরে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৪ আগস্ট জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলমকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠনো হয়েছে। ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহম্মদ সালাহ উদিনকে ওএসডি বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়েছে।

এদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৭ আগস্ট প্রথমবারের মতো অবসরে চলে যাওয়া পাঁচ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে বলে জানা গেছে। অবসরে যাওয়ার সময় তারা অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। ড. শেখ আবদুর রশিদ পেয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। জননিরাপত্তা বিভাগে ড. মোহম্মদ মোমেন, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে এহছানুল হক, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ড. নাসিমুল গনি ও রেলপথ বিভাগে এম এ আকমল হোসেন সচিব পদ পেয়েছেন।

আগামী অক্টোবরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। চলতি বছর আরও যাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে বা স্বাভাবিক অবসরে যাবেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, বিমানসচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, ওএসডি সচিব খাজা মিয়া, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, ধর্মসচিব মু. আবদুল হামিদ জমাদ্দার, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আবদুল বাকী, ভূমিসচিব খলিলুর রহমান, পূর্তসচিব নবীরুল ইসলাম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ, আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ ও বাণিজ্য সচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন, যুব ও ক্রীড়াসচিব ড. মহীউদ্দীন আহমেদ ও বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হাবিবুর রহমান।

প্রশাসনের অস্থিরতা নিয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন আর কোনও মন্তব্য জানতে চাইবেন না। এখন আমাদের পক্ষে কোনও বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক না। এমনিতেই চাপের মধ্যে আছি। কোনও কাজ আসলে করতে পারছি না। কখন চলে যেতে হয় জানি না। সেই আতঙ্কেই দিন কাটছে।’

একই ধরনের মন্তব্য করেছেন রংপুর বিভাগে কর্মরত একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। তিনি জানিয়েছেন, ‘এখন কোনও কাজ নয়। কখন চলে যাওয়ার আদেশ আসে সেই চিন্তায় আছি। এর ওপর নিরাপত্তার অভাব তো রয়েছেই। সরকারি চাকরি করি। তাই মুখ ফুটে তো অনেক কিছু বলতেও পারছি না।’

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান জানিয়েছেন, ‘প্রশাসনের অস্থিরতা দ্রুত শেষ করতে হবে। এটি করা না গেলে সরকারি কাজে পুরোপুরি স্থবিরতা নামবে। এতে জনসেবা বা নাগরিক সেবা বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে স্বাভাবিক পদোন্নতির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা স্বাধীন জনপ্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর। তবে অভিজ্ঞদের বিষয়টি আলদা।’

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রশাসনে অস্থিরতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যে কোনও প্রকারে হোক এই অস্থিরতা কাটাতে হবে। প্রশাসনে স্থরিরতা এলে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’

About Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat