ফ্রান্সের উড়োজাহাজ ও স্যাটেলাইটে আস্থা রাখায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ ম্যাক্রোঁর
ফরাসি আকাশযানের ওপর আস্থা রাখার জন্য এবং তাদের থেকে উড়োজাহাজ ও স্যাটেলাইট কেনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দ্বি-পক্ষীয় এবং একান্ত বৈঠক শেষে এক যৌথ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘ইউরোপিয় অ্যারোনটিকসে আস্থা রাখার জন্য এবং ১০টি এ-৩৫২ নেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। উড়োজাহাজের দিক দিয়ে এয়ারবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্র্যান্ড। ফ্রান্স বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। জ্বালানি ও সামরিক খাতের পাশাপাশি সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে আপনারা ফ্রান্সের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
এদিন দু’দেশের নেতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট এবং বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
এর মধ্যে একটি হলো ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট বা ঋণ চুক্তি।
অপরটি হলো বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম বিষয়ে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এর মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে একটি লেটার অব ইনটেন্ট চুক্তি।ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এ সফরে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলও গুরুত্ব পেয়েছে।
সংবাদমাধ্যম এএফপি জানিয়েছে, ফ্রান্স তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে ‘শক্তিশালী’ করতে এবং এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বা ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’ প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সফর করছে।দেশটি তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
ম্যাক্রোঁ শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নতুন সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি। এখন আমরা গণতান্ত্রিক নীতি এবং আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে একটি তৃতীয় উপায় প্রস্তাব করতে চাই। যেখানে আমাদের কোনো অংশীদারকে খাটো করা হবে না বা তাদেরকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে না।’ভারতে জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর রোববার ঢাকায় এসে তিনি এ কথা বলেন।
এএফপি বলছে, মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ইন্দো-প্যাসিফিকের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রভাব খাটানোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সকে একটি বিকল্প হিসেবে সামনে দাঁড় করাতে চাইছেন।
ম্যাক্রোঁ তার সফরে বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটি ‘অসাধারণ সাফল্য’ অর্জন করেছে, বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে তার স্থান ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করছে।
প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা বিশ্বের অষ্টম জনবহুল বাংলাদেশ অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল রেখেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে যেসব খাতে ফ্রান্স শক্তিশালী ওই সব খাতে বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব করতে চায় দেশটি।
ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘রাশিয়া যখন ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করতে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, এ অবস্থায় আমাদের দায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুদের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং টেকসই বিকল্প প্রস্তাব করা। আমরা বাংলাদেশের সাথে এই পথে চলতে চাই।’
রোববার নৈশভোজে ম্যাক্রোঁর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, “কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপনার গুরুত্ব আরোপ মূলত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা আপনাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশুদ্ধ বাতাসের নিঃশ্বাস হিসেবে দেখি।”
ফরাসি মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান থালোস ইতোমধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাডার ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ করছে।একই প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করা বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ তৈরি করেছিল।
২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট সই হয়। এবারে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ফ্রান্স কেনার বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হলো।
একই সাথে সরকার বাংলাদেশ বিমানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং উড়োজাহাজ বহর থেকে সরে গিয়ে ফরাসি এয়ারবাসের কাছ থেকে ১০টি বিমান কেনার বিষয়েও চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর চলতি বছরের শুরুতে ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানি থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।
এ নিয়ে ঢাকায় কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংয়ের আধিপত্য কমাতে বাংলাদেশে বিমান বহরের জন্য এয়ারবাস কোম্পানির উড়োজাহাজ কেনার কথা বিবেচনা করছে বাংলাদেশ সরকার।ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফর আরো কয়েকটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, ফ্রান্স বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে অনেক দিন ধরে। দেশটি মিলিটারি হার্ডওয়্যার শিল্পেও বেশ প্রভাবশালী।
আবার ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ফ্রান্সের আলাদা কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে এবং এ অঞ্চলে দেশটির সামরিক উপস্থিতিও আছে। দেশটি এখন চাইছে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার মো: আব্দুল হান্নান রোববার বলেছেন, ফ্রান্স ইউরোপের প্রভাবশালী একটি দেশ এবং ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক বিবেচনায় ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেছেন, ‘কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ফ্রান্সের গুরুত্ব দেয়ার প্রমাণই হলো দেশটির প্রেসিডেন্টের সফর। আশা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ২২টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ফ্রান্স প্রযুক্তি ও ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ কারণে শীর্ষ পর্যায়ের এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
ফরাসি প্রেসিডেন্টের এলিসি প্যালেস দফতর থেকে বলা হয়েছে, ঢাকা সফর হবে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির একটি দেশের সাথে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক গভীর করার প্রয়াস এবং এর মাধ্যমে ফ্রান্স তাদের অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে চায়।
ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছে, প্রেসিডেন্টের এই সফরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরও বলেছে, এই সফর দু’দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।রোববার রাত ৮টার দিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৯০ সালে ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর সফরের ৩৩ বছর পর ফ্রান্সের কোনো প্রেসিডেন্টের এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর।
সূত্র : বিবিসি