নাহিদ ইসলাম যেভাবে বাংলাদেশের ছাত্র বিপ্লবের মুখ হয়ে উঠলেন
দেশজুড়ে কয়েক মাসে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তার অন্যতম পরিচিতি মুখ হলেন নাহিদ ইসলাম। তিনি দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এ সময় তার থিসিসের বিষয় ছিল, বাংলাদেশে কেন কোনো ছাত্র আন্দোলন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এর উপসংহারে তিনি কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেছেন কিনা, তা কোনো বিষয় নয়। তবে সত্য হলো, ২৬ বছর বয়সী এই ছাত্রনেতা দেশের ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর নারী হিসেবে এক সময় প্রতিষ্ঠিত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
আন্দোলনের সূচনা হয় জুন মাসে। ওই সময় সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেছিল হাইকোর্ট। এর প্রতিবাদে কয়েকজন শিক্ষার্থীর নিয়ে নাহিদ ইসলাম প্রবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। এ সময় তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। এর মাধ্যমে অন্যদেরকে রাজপথে নামার আহ্বান জানান তারা। এ সময় নাহিদ ইসলাম ও তার সঙ্গীরা সবার জন্য সুষ্ঠু সুযোগের দাবি জানাতে থাকেন।
কোটাবিরোধী এই আন্দোলন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় প্রথম ২০১৮ সালে। ওই সময় সরকার পশ্চাৎধাবন করে। ফলে আন্দোলন মরে যায়। নাহিদ ইসলাম বলেন, এ বছরও তারা (সরকার) কোটা ব্যবস্থার ইস্যুকে শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু তার পরিবর্তে বিক্ষোভকারীদের ওপর সরাসরি গুলি শুরু করে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ১৬ জুলাই বুক চেতিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছাত্র আবু সাঈদ। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
নাহিদ বলেন, তাকে হত্যা করায় আন্দোলনের গতি মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে যায়। মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে জনগণের বৃহৎ অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে জনগণের মধ্যে যে পাহাড়সম হতাশা কাজ করছিল, তার ফলে জনগণ নেমে আসে রাজপথে।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে দৃষ্টি দেয়। ৩ আগস্ট তারা একদফা দাবি তুলে ধরে। এই দাবি ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। এরপর ৫ আগস্ট লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের খুব কাছাকাছি চলে যান। তখন হেলিকপ্টারে আরোহণ করেন শেখ হাসিনা এবং পালিয়ে ভারতে চলে যান। তারপর থেকে সেখানেই তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে, তা কেউই কল্পনাও করেনি। সেনাবাহিনীর সমর্থনে ছাত্ররা ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের দায়িত্বে চলে আসেন আকস্মিকভাবে। তারা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে (৮৪) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার অনুরোধ করেন। ড. ইউনূস তার ক্ষুদ্রঋণ ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। এতে তিনি খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছেন। এই অর্থনীতিবিদ তখন নিজে বিদেশে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের মামলা ছিল। তিনি ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিলেন। তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেয়া হলো।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস এখন নাহিদ ইসলামের বস। এর একমাত্র কারণ হলো তারা এভাবে তাকে চেয়েছিলেন। কে কার কাছ থেকে নির্দেশ নিচ্ছেন- এমনটা প্রশ্ন করতেই নাহিদ ইসলাম হাসেন। তারপর বলেন, বড় সব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই ড. ইউনূস আমাদের সাথে পরামর্শ করেন। তার মন্ত্রণালয়ে টেবিলের ওপর লাল একটি টেলিফোন দেখিয়ে বলেন, এই যে ভিআইপি ফোন। আমার কোনো ধারণা নেই যে কিভাবে এটা ব্যবহার করা উচিত। ফলে হোয়াটসঅ্যাপে আমি ড. ইউনূসকে টেক্সট মেসেজ পাঠাই। বিগত কতোগুলো সপ্তাহে তার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার সবটাতে তিনি এখনো বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু তার আচরণ তা দূরে সরে যেতে দেয় না।
সমাজবিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা এই যুবক বিগত সরকারের বিপক্ষে অবস্থানকারীদের মধ্যে অন্যতম। ঢাকায় জন্ম নেয়া নাহিদ একজন শিক্ষকের ছেলে। তিনি ২০১৭ সালের প্রথম সপ্তাহে সুন্দরবনের কাছে একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। ২০১৯ সালে তিনি ক্যাম্পাসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। পরে সিনিয়রদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করেন ছাত্রবিষয়ক সংগঠন ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফোর্স। কিন্তু এ বছর জুলাই মাসে তাকে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা অপহরণ করে নির্যাতন করে। এটি হলো সরকারের সমালোচকদের জোরপূর্বক গুম করে দেয়ার একটি রীতি। সেই থেকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পান নাহিদ ইসলাম। গ্রেফতার এড়াতে তিনি এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। এক তীব্র গরমের রাতে সাদা পোশাকে প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। তিনি বলেন, তারা তার মাথায় কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলে। তারপর বলে, বিশ্ব তোমাকে আর কখনো দেখতে পাবে না।
নাহিদ ইসলাম মনে করেন, তাকে তাদের গোপন বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রহার করা হয়। নাহিদ মনে করেন, লোহার রড দিয়ে তাকে প্রহার করা হয়েছে। এতে তার বাহুতে এবং পায়ে কালশিটে দাগ হয়ে যায়। প্রচণ্ড ব্যথা, বিকট শব্দ এবং অতি উজ্জ্বল আলো তার দিকে সেট করে দেয়া হয়। এতে তার মাথা ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝেই তিনি চেতনা হারান। নাহিদ বলেন, তারা জানতে চায় যে এই আন্দোলনের মূল হোতা কে? কোথা থেকে অর্থ আসছে? তিনি আরো বলেন, একদিন পর তাকে একটি ব্রিজের পাশে ফেলে রাখা হয়। স্থানীয় মিডিয়ায় তার আহতের ছবি প্রকাশ হয়। তাতে ক্ষোভ আরও বাড়ে।
তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলনের নেতা, যারা পরিচিত মুখ তাদের খুঁজছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কিন্তু আমরা তো একজন ছিলাম না। এটাই ছিল আমাদের শক্তি। তিনি আস্থার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে নতুন দায়িত্বে মনোনিবেশ করছেন। তারপরও বলেন, আন্দোলন ছিল একটি টিমওয়ার্ক। তার ভাষায়- মিডিয়া সব সময় একটি মুখ খুঁজেছে। কিন্তু এই আন্দোলনে আমিই একমাত্র নেতা ছিলাম না। আমরা ছিলাম অনেকজন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূরণ হয় দ্রুততার সাথেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. সামিনা লুৎফে বলেন, যেদিন অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা সেদিন তিনি নাহিদ ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন- সে খুবই তরুণ। এটা বিশাল এক দায়িত্ব।
তাদেরকে পুনর্বিবেচনা করার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। এই নতুন বাংলাদেশে ছাত্রদের কাছ থেকে তারা সর্বোত্তম প্রত্যাশা করেন। এই ছাত্ররাই তাদের নির্দেশনা দিয়ে একজন স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। এখন বহু মানুষ ওই শাসককে প্রকাশ্যে স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করার সাহস দেখান।
নাহিদ ইসলামের ফোন আবার বাজতে থাকে। কথিত অবহেলার দায়ে একজন ছাত্র মারা যাওয়ার পর ছাত্ররা চিকিৎসকদের ওপর হামলা করেছে। এ ঘটনায় ঢাকার হাসপাতালে মধ্যস্থতা চাওয়া হয় তার কাছে। ওই ঘটনায় চিকিৎসকরা ধর্মঘট করেন। যখন তিনি মুরগির মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, তখনই আরেকটি কল আসে।
যেসব শিক্ষার্থী সরকারি চাকরি দাবি করেছিলেন তাদের কারও কাছে কি তার (নাহিদ) নাম্বার প্রফেসর ইউনূসের অফিস শেয়ার করতে পারে? নাহিদ ইসলাম বলেন, এটা অদ্ভুত। আন্দোলনকারীদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, একদা আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম। এখনো আমরা এক আছি। আমাদেরকেই সব ম্যানেজ করতে হবে। ভোট জালিয়াতি, সমালোচকদের দমনপীড়ন এবং ভয়ের পরিবেশে ১৫ বছরের শাসনের মধ্যে থাকার পর জনগণের কণ্ঠস্বর সফলতা পেয়েছে এ জন্য বাংলাদেশিরা শক্তি পেয়েছেন। জনগণ এখন তাদের নতুন স্বাধীনতা ব্যবহার করছে। হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন নারীরা। কয়েক সপ্তাহে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বিঘ্ন ঘটার কারণে স্থগিত পরীক্ষা বাতিল চাইছেন শিক্ষার্থীরা। এমনকি ঢাকার উঁচু স্তরের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। তারা বলছিলেন- তাদের প্রিন্সিপালকে পছন্দ নয়। নাহিদ বলেন- ১৫ বছর ধরে মানুষ কথা বলতে পারেনি। এখন সুযোগ পেলেই তারা কথা বলছেন।
তবু তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সামনে। দেশে স্বস্তির পরিবেশ থাকলেও তা উদ্যাপনের অনেক বেশি সময় নেই। নতুন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন। নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা, নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে আসা। তিনি আরও বলেন, আমরা অল্প সময়ের জন্য এ দায়িত্বে আছি। সব রকম দুর্নীতি এবং সহিংসতা জনগণ আর চায় না। নতুন প্রজন্মের পালস আমাদের বোঝা উচিত। আমাদের উচিত সামনে এগিয়ে যাওয়া।
সূত্র : টাইম ম্যাগাজিন