বিএনপিতে ব্যাপক রদবদল
গত দুই দিনে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর অনেক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে করা হয়েছে ব্যাপক রদবদল। কাউকে দেওয়া হয়েছে পদন্নোতি, আবার কারো করা হয়েছে পদাবনতি। সব মিলিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোতে বেশ পরিবর্তন আনা হয়। এ নিয়ে দলের মধ্যে কেউ-কেউ খুশি হলেও অনেকে পদ বাঁচানো নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
শনিবার (১৫ মে) বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে রদবদল ও নতুন করে ৪৫ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের অনেককে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে যুক্ত করা হয়েছে। আবার কাউকে পদাবনতি করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বেশ কয়েকজনকে পদন্নোতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনেককে নতুন করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছ।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে রদবদলের পাশাপাশি দলের বর্তমান বিদেশ বিষয়ক কমিটি ভেঙে দিয়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি। চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই আছেন।
গত ১৪ মে বিগত সরকার বিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণে ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর-দক্ষিণ উভয় কমিটির পাশাপাশি বরিশাল মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়। একই কারণে কেন্দ্রীয় যুবদলের কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণে দলের ও অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। আর দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যেসব নেতার পদাবনতি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় না থাকার অভিযোগ ছিল। আবার যাদের পদন্নোতি দেওয়া হয়েছে এবং নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের চোখে হয়ত তারা সফল। কিন্তু আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য যদি দলের মধ্যম সারির নেতাদের পদাবনতি দেওয়া হয়। তাহলে ধরে নিতেই হবে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাহলে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহা-সমাবেশের দিন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের যেসব নেতা মঞ্চ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বিচার হবে না কেন? এরপর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেসব নেতা জেলের বাইরে ছিলেন, কিন্তু মাঠের নেতারা তাদের খুঁজে পায়নি এবং যাদের ভুল কৌশলের কারণে আন্দোলন সফল হয়নি তাদের বিচার হবে না কেন? এসব প্রশ্ন তো এসে যায়।
বিএনপিতে হঠাৎ রদবদল নিয়ে অনেকের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে চাচ্ছেন না। পদ হারানোর ভয় কাজ করছে নেতাদের মধ্যে। তারা বলছেন, নানা বিবেচনায় বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোতে এ পরিবর্তন ও সংযোজন করা হয়েছে। এগুলো দলের ধারাবাহিক সাংগঠনিক কাজের অংশ। আবার কেউ-কেউ বলছেন, দীর্ঘদিন দলের কাউন্সিল হয় না। তাই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কাউন্সিল না করার চাপ এড়িয়ে বেশ কিছু পদে রদবদল করে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছেন। সেটা দলের আন্দোলন-সংগ্রামে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা দেখার বিষয়।
পদে রদবদল হয়ে প্রচার সম্পাদক থেকে যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। তিনি বলেন, এটি হঠাৎ রদবদল নয়, এটি পার্টির ধারাবাহিক সাংগঠনিক কাজের অংশ। সামনে হয়ত আরও হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নানা বিবেচনায় এসব করা হয়েছে। যেসব কমিটির মেয়াদ নেই, সেগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আবার যেসব কমিটির মেয়াদ আছে, সেগুলোতে নতুন নেতৃত্ব দেওয়ার দরকার প্রয়োজন আছে বলে তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আবার কারও-কারও পদ থাকলেও পদোন্নতি দরকার বিবেচনায় তাদের নতুন পদ দেওয়া হয়েছে।
এতো রদবদল করে বিএনপি তার আন্দোলন-সংগ্রামে কতটুকু সফল হতে পারবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি, অনেকাংশে সফল হয়ে গেছি আমরা। এই সরকারকে মানুষ ভোট দেয়নি। তাদের নৈতিক কোনো ভিত্তিও নেই। জোর করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। তাদের লুটের খবর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপিতে এখন চমকের পর চমক চলছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায় এ চমকের পরে কী হবে? আন্দোলন সংগ্রামে সফলতা আসবে তো?
তিনি আরও বলেন, যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তারা সবাই তো খুশি নন। কারণ দেখা যাচ্ছে তার থেকে জুনিয়রকে উপরের পদে পদোন্নতি দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে, সবকিছু মিলিয়ে ঈদের আগে বিএনপিতে কিছুটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
এদিকে পদাবনতি হওয়া এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে বাদ পড়া বিএনপি নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। এ রকম তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। তারা বলেন, মাঠের সরকার বিরোধী কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যর্থতার জন্য যদি আমাদের পদ যায়, একই কাজে যাদের নীতি প্রণয়নে অদূরদর্শিতা ছিল তাদেরও বিচার হওয়া উচিত।
পদাবনতি হওয়া এক নেতা বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির মাত্র ২ জন সদস্য কারাগারে ছিলেন। বাকিদের তো আন্দোলনের মাঠে দেখা যায়নি। কিন্তু এখন সব ব্যর্থতা শুধু আমাদের কাঁধে?
পদাবনতি হওয়া আরেক নেতা বলেন, ২০১৬ সালের পরে বিএনপির কোনো কাউন্সিল হয়নি। এই নিয়ে দলের ভেতরে মাঝে-মধ্যে আলোচনা উঠে। এখন দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে আবারও কখন কাউন্সিল করা যাবে সেটাও বলা সম্ভব নয়। ফলে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চিন্তা করছেন কিছু লোকের পদ-পরিবর্তন, কাউকে নতুন করে যুক্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুনত্ব আনতে। এছাড়া আর কিছুই নয়।