দেশের বাইরে আটকে থাকা ডলার ফেরাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ
পণ্য রপ্তানি হলেও নির্ধারিত সময়ে যেসব রপ্তানি আয় দেশে আসেনি, আটক থাকা সেই ডলার বা অর্থ দ্রুত দেশে আনতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
বুধবার এসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এমন নির্দেশনা দেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, হুন্ডি প্রতিরোধ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব, ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি, সিআইবি তথ্য হালনাগাদ, খেলাপি ঋণের উচ্চ হার ও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়।
ডলারের বিনিময় হারের নিয়ম না মানায় যে দশ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তার মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরাও উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।
এবিবি চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, গভর্নর বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফ এর বৈঠকে যোগ দিতে মরক্কো গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পর ওই বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। আমরাও কয়েকটা বিষয় জানালাম।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি আয় এসেছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
বাকি থাকা ৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে বেশ কিছু অর্থ ‘ডেফার্ড হয়েছে’ বলে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়। কিন্তু কতটা পিছিয়েছে বা কতটুকু রপ্তানি আয় দেশে আসছে না, তার কোনো সঠিক তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিকদের জানায়নি।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা ধারণা দিয়ে বলেছেন, না আসা রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৩-৪ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, কিছু রপ্তানি আয় ডেফার্ড হয়েছে সত্য। তারপরও ডেফার্ড হওয়া রপ্তানি আয় বাদ দিলে বড় একটি অংশ দেশে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দ্রুত ব্যাংকগুলোকে রপ্তানি আয় দেশে ফেরত নিয়ে আসতে।
ডেফার্ড মানে হলো- কোনো রপ্তানি আয় পরিশোধে সময় বাড়িয়ে নেয়া। মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া সময়ের জন্য সুদ পরিশোধ করে বিদেশি ক্রেতা।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে আটকা থাকা রপ্তানি আয় দেশে ফেরত আনতে নির্দেশনা দিয়েছে। কী পরিমাণ অর্থ দেশে আসতে পারে জানতে চাইলে সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, গভর্নর জানিয়েছেন, অনেক রপ্তানি আয় দেশে আসেনি।
ব্যাংকগুলো চেষ্টা করবে যথা সময়ে রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসতে। গভর্নরও আহ্বান জানিয়েছেন তা ফেরত আনতে।
ব্যাংকের চেয়ে খোলা বাজারে ও হুন্ডিতে ডলারের দর অনেক বেশি। তা সমন্বয় করা ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, বছরে ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন ডলার হাত বদল হয় খোলা বাজারে। তার উপর নির্ভর করে ব্যাংকের ডলারের দর ঠিক করা যায় না।
যারা অর্থপাচার করেন, হুন্ডি করেন, যে দরেই পাবেন, তারা ডলার কিনবেন। আমরা যদি ব্যাংকে ডলার ১৩০ টাকা করি, দেখা যাবে হুন্ডিওয়ালারা ১৪০ টাকা- ১৫০ টাকা দেবে। তাদের তো টাকা বিষয় না, সবই ব্ল্যাকমানি। যারা বিদেশে টাকা পাচার করে, তাদের কাছে বিনিময় হার কোনো বিষয় নয়, যে কোনো মূল্যে তারা তা করবে। হুন্ডির সাথে রেট মেলানোর কিছু নেই। এটা কোনো বেঞ্চমার্ক হতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা ব্যাংকগুলোর ঋণ তথ্য ভাণ্ডার ‘ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো’র (সিআইবি) তথ্য হালনাগাদ করা এবং ব্যাংকের শাখা পর্যায় থেকে তথ্য সরাসরি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরা হয় বৈঠকে।
ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে কী কী পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে, তা সরাসরি না জানিয়ে সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, সিআইবি নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে। বৈঠকে এ বিষয়ে ব্রেইনস্টর্মিং সেশন করে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। আশা করি দ্রুত একটি সমাধান হয়ে যাবে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ওই বৈঠকের বিষয়েও বুধবার গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে জানানো হয়েছে। সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোর ওপর তারল্যের চাপ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার এ উদ্যোগে আমানত ও ঋণ সব পর্যায়েই সুদহার বাড়বে বলে জানান সেলিম আর এফ হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এবিবি নেতাদের জানানো হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। মুদ্রানীতিতে সংকোচনের যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে- তার প্রভাব কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা এবং রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, হুন্ডি প্রতিরোধসহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশা করা যায় আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়ে যাবে।
এবিবি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে এদিন প্রাইমার ডিলার ২১ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেন ও দর বৃদ্ধিতে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় কেমন প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়।