ড. ইউনূসের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ সদস্যের যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৩১শে আগস্ট এই অর্থনীতিবিদের চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নজুুমিয়া হাটের বাড়িতে যান এক পুলিশ পরিদর্শক। তিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে ড. ইউনূস এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করেন। কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাইয়ের সঙ্গেও। ড. ইউনূসের ভাই মাঈনুল ইসলাম এবং স্থানীয়রা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। যদিও হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তা অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হাটহাজারী থানার ওই পুলিশ পরিদর্শকের নাম মো. আজম। তিনি প্রথমে নজুমিয়া হাটের সারের দোকানি মঞ্জুর আলীর কাছে ড. ইউনূসের বিষয়ে জানতে চান। তার পরিবারের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে তা জানতে চান। এ বিষয়ে মঞ্জুর আলী মানবজমিনকে বলেন, গত ৩১শে আগস্ট দুপুরে পুলিশ এসে আমার কাছে ড. ইউনূসের বিষয়ে জানতে চান। পরে একপর্যায়ে আমি ওই পুলিশ সদস্যকে ড. ইউনূসের ছোট ভাই মাঈনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি।
তিনি আমার কাছ থেকে মাঈনুলের ফোন নম্বর নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। মঞ্জুর আরও বলেন, প্রথমে মদুনাঘাট বিটের এসআই মো. আজম ড. ইউনূসের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে কে কোথায় আছেন, তারা কী করেন জানতে চান। তারা কোথায় লেখাপড়া করেছেন। তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কিনা? ড. ইউনূস কোথায় লেখাপড়া করেছেন- এসব তথ্য জানতে চান। ওই এসআই জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ওই এসআই আরও জানান, ইউনূসের অবস্থান ও পরিবারের সকল সদস্যের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। তাই তিনি গ্রামের বাড়িতে এসেছেন।
হাটহাজারী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ড. ইউনূসের বাড়িতে কে গেছেন তা আমার জানা নেই। আমার থানার কোনো পুলিশ তার বাড়িতে যায়নি। এ বিষয়ে ড. ইউনূসের ভাই মাঈনুল ইসলাম বলেন, পুলিশ আমার কাছে অনেক তথ্য জানতে চেয়েছে। ড. ইউনূস প্রাথমিক থেকে কোথায় কোথায় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তার পরিবারের সবার নাম কী এবং বর্তমানে কে কোথায় আছেন? তিনি কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন কিনা। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন কিনা। পরিবারের সদস্য ভাইবোন কতজন, সবার নাম, মায়ের নাম। ভাইবোনরা কী করেন? তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা? শেষ কবে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। এসব জানতে চাওয়া হয়। আমি যতটুকু জানি জবাব দিয়েছি। পরে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি হাটহাজারী থানার মদুনাঘাট বিট পুলিশের এসআই আজম বলে পরিচয় দেন।
১৭৬ মামলার বেড়াজালে ড. ইউনূস
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে ঝুলছে ১৭৬টি মামলা। যার মধ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘনে দুটি ফৌজদারি ও বাকিগুলো দেওয়ানি প্রকৃতির। এ ছাড়া কর গড়মিলের একটি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। তবে দুদকের দায়ের করা মামলাটিতে এখনো চার্জশিট হয়নি। তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। কলকারখানার দায়ের করা মামলাটি মতিঝিলের শ্রম আদালতে বিচার কার্যক্রম চলছে।
গত মঙ্গলবার শ্রম আদালতে কলকারখানা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলার বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। আগামী ১৩ই সেপ্টেম্বর এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। চলমান এই মামলায় যেসব ধারা রয়েছে সেসব ধারা লঙ্ঘনে আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ ৬ মাসের সাজা হতে পারে। অন্য দুটি ধারায় ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে। ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুনের দাবি যারা ইউনূসকে পছন্দ করেন না তারাই মূলত তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করাচ্ছেন। কলকারখানার পক্ষে দায়ের করা মামলাটি মূলত দেওয়ানি প্রকৃতির। যেসব অভিযোগে এই মামলা করা হয়েছে তার প্রতিকার দেওয়ানি মামলায় রয়েছে। কিন্তু তারপরেও কলকারখানা অধিদপ্তর ফৌজদারি ধারায় অভিযোগ এনে মামলা করেছে। কেন করেছে? তা এখন সবারই জানা। তিনি ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা কলকারখানার মামলাসহ কোনো মামলারই ভিত্তি নেই বলে মন্তব্য করেন।
অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে মামলা চলছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে কলকারখানা কতৃপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট খুরশিদ আলম খান বলেন, মামলার কার্যক্রম আইনানুযায়ীই পরিচালিত হচ্ছে। এখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। এটি সরকারের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলা নয়। এটি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের একটি মামলা। তিনি (ইউনূসের আইনজীবী) আদালতে যখন সময় চাচ্ছেন, আদালত তখনই সময় দিচ্ছেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনানি করছেন। এরপরেও তিনি অভিযোগ করার জন্য অভিযোগ করছেন। কলকারখানার পক্ষে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, বিবাদীর আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন মামলার ভিত্তি নেই বলে যে অভিযোগ করেছেন, আসলে তার এই অভিযোগের ভিত্তি নেই। ভিত্তি আছে বলেই তো আদালত মামলা গ্রহণ করেছে।
গত ৩০শে মে গ্রামীণ টেলিকম থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রফেসর ড. ইউনূস সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২)(৩) ধারায় অভিযোগ করা হয়েছে। এসব ধারায় কী সাজা হতে পারে সে প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার খাজা তানভির আহমেদ বলেন, ৪০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। ৪২০ ধারায় ৭ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড, ৪৬৭ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম এবং অর্থদণ্ড। ৪৬৮ ধারায় ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম এবং অর্থদণ্ড। মানিল ন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২) ধারায় সর্বনিম্ন্ন ৪ বছর এবং সর্বোচ্চ ১২ বছর সাজা রাখা হয়েছে। এর অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকা যা অধিক অর্থদণ্ড হতে পারে।
ইউনূসের আইনজীবীর দেয়া তথ্য মতে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৭৬টি মামলার মধ্যে- গ্রামীণ টেলিকমের ৬৪টি, গ্রামীণ কল্যাণের ৬৯টি, গ্রামীণ কমিউনিকেশনের ২৫টি, গ্রামীণ ফিসারিজের ৮টি, ইনকাম ট্যাক্সের ৮টি ও ফৌজদারি ২টি। তাদের ৫০টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখনো সব মামলা যোগ করা সম্ভব হয়নি। দুই-এক দিনের মধ্যে হালনাগাদ করা হবে। এরই মধ্যে গত ৩০শে আগস্ট রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রামীণ ব্যাংক এক চিঠিতে ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সকে জানায়, তাদের সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করা হবে না। এই প্রতিষ্ঠানে ৯৫০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক যদি চুক্তি নবায়ন না করেন তাহলে তো প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে হবে। এমনটি হলে আরও মামলার আশঙ্কা করছেন ড. ইউনূসের আইনজীবী।
ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, একের পর এক শ্রমিকদের দিয়ে মামলা করানো হচ্ছে। সর্বশেষ গত ২৮শে আগস্ট ১৮ জন শ্রমিক মামলা করেছেন। এখনো দেড় শতাধিক শ্রমিকের মামলা বিচারাধীন। কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের মুনাফা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আইনানুযায়ী বণ্টন হওয়ার কথা নয়। তারপরেও ১৭৬ জন শ্রমিককে ৪৩৭ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের গ্রামীণ ব্যাংক এক চিঠিতে জানিয়েছে, গ্রামীণ টেলিকমিউনিকেশন্সের সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করবে না। চুক্তি নবায়ন না করলে প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ থাকবে না। শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে। এরপর শ্রমিকরা আরও মামলা করবে। ব্যারিস্টার মামুন বলেন, ফৌজদারি আইনে করা দুটি মামলার মধ্যে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মামলাটি অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। তিনটি অভিযোগে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। দেওয়ানি এবং প্রশাসনিক অপরাধকে ফৌজদারি হিসেবে গণ্য করে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। শ্রম আইনের ১৯ অধ্যায়ে কোন কোন অপরাধ ফৌজদারি অপরাধ হবে, তার একটি তালিকা রয়েছে। ওই তালিকায় এই তিনটি অপরাধের উল্লেখ নেই। এসব অপরাধকে ফৌজদারি হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক হয়নি।