যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মূলত কী চায়, কী চায় না

নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সরকারকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারতেরও হস্তক্ষেপ নিয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের তৎপরতাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে গিয়ে বৈঠক করেছে সেদেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রতিনিধিদের সাথে।সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে গিয়ে বৈঠক করেছে সেদেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রতিনিধিদের সাথে।
তারা বলছেন, এখানে গণতন্ত্র বা নির্বাচন মূখ্য বিষয় নয়। মূল কথা হলো, যার যার স্বার্থ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যার যার সুবিধা বিবেচনায় রাজনীতি করছে।
ডয়চে ভেলে এবং ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রতিবেদনে সূত্রের বরাতে যা বলা হয়েছে তার বার্তা হলো- ভারত অ্যামেরিকাকে বলতে চেয়েছে, শেখ হাসিনাকেই তারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চায়। এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারত যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, সেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং এই অঞ্চলের মানুষের জন্য শুভ হবে না। যদি নিউজটা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তারা হস্তক্ষেপ করছে।’ আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সমমনারা দৃশ্যত এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভারত কী একটা বার্তা দিয়েছে, সেখানে কমেন্ট করে, অবস্থাটা এমন, ভীতি-ভয়ে হাত পা মনে হয় গুটিয়ে ফেলেছে নেতারা (বিএনপির)। ভারত ভীতিতে সারা রাতে কয়বার যে জাগন হয়, ঘুম ভেঙে যায়। যারা যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা পাঠানোকে ভারতের হস্তক্ষেপ বলেন, তাহলে ৭১ সালে কী হয়েছিল? ভারত ওই সময় আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। তাদের সৈন্যরা রক্ত দিয়েছে, আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। অস্ত্র দিয়েছে, ট্রেনিং দিয়েছে; সেটা কি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ?’
ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের এই ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র আগেই নতুন ভিসা নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দেবে, তাদের ভিসা না দেয়ার কথা বলেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত উভয় দেশই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। এখানে সব সময়ই হস্তক্ষেপ হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সেটাকে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার দিক থেকে দেখে। যার পক্ষে যায় সে স্বাগত জনায়, যার বিপক্ষে যায় সে হস্তক্ষেপ বলে। এটাই হলো এখানকার রাজনীতি। এখানে সত্যের সাথে সম্পর্কের কোনো বিষয় নেই। যার যার সুবিধা বা অসুবিধা বিবেচনা করে তারা কথা বলে।’
তিনি বলেন, ‘ভারত তো চাইবেই এই সরকার ক্ষমতায় থাকুক। তারা ১৫ বছর ধরে এই সরকারের সাথে ডিল করছে। অনেক সুবিধা নিয়েছে। সামনে আরো সুবিধা চাইবে। অ্যামেরিকার অবস্থাও তাই। তারা তাদের স্বার্থ চায়। তারা চায় বাংলাদেশ তাদের অনুগত থাকুক।’
আর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা সিলেকটিভলি ফোকাসড হয়ে যাচ্ছি। তাই যার যার স্বার্থ বিবেচনা করে হস্তক্ষেপ বা হস্তক্ষেপ না-বিষয়গুলো বিবেচনা করছি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। তারা যার যার সুবিধা চিন্তা করে। কিন্তু মূল বিষয় হলো, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কে কী বললো সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত না।’
তার কথা, ‘আমরা তো জানি না আগামী নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে। তবে ভারত ১৫ বছর ধরে এই সরকারের সাথে কাজ করছে। ফলে এই সরকার ক্ষমতায় এলে তার হয়তো সুবিধা হবে। আবার অ্যামেরিকা যে গণতন্ত্রের কথা বলে তা একেক দেশের জন্য একেক রকম। সে তার স্বার্থ চিন্তা করেই গণতন্ত্রের কথা বলে। তবে আমাদের গণতন্ত্র তো আমাদের স্বার্থেই প্রয়োজন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজার্তিক সম্পর্কের সাবেক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রেজিমের পরিবর্তন চায় বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তারা শেখ হাসিনার সমর্থন পাবে না। কারণ, তিনি এখন চীনের দিকে ঝুঁকে আছেন। যুক্তরাষ্ট্র এখন বার্মা অ্যাক্ট কার্যকর করতে চায়। সেটা করতে বাংলাদেশে তাদের একটা অবস্থান দরকার। আর ভারত চায় বাংলাদেশের সাথে যত চুক্তি হয়েছে তার সুফল ভোগ করতে। সেটা শেখ হাসিনা ছাড়া পুরোপুরি সম্ভব হবে বলে তারা মনে করে না। ভারতের একটি বিষয় হলো তারা অ্যামেরিকার ও রাশিয়া দুই দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক করতে চায়। আবার মিয়ানমারে কালাদান প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে চীনকেও গুড হিউমারে রাখতে চায়। এটা অ্যামিরকার পছন্দ নয়।’
তার কথা, ‘সামনে ভারত ও অ্যামেরিকার বাংলাদেশকে নিয়ে অবস্থানে আরো দূরত্ব বাড়তে পারে। ভারত তার নিরাপত্তার দিক দিয়ে বাংলাদেশকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আর তারা তার জন্য শেখ হাসিনা সরকারকেই নির্ভরযোগ্য মনে করে। কিন্তু অ্যামেরিকা তার স্বার্থে কাজ করবেই। এখানে দুই দেশের নিজস্ব স্বার্থ বড় কথা।’
শেখ হাসিনা দুর্বল হলে বাংলাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে। ভারতের এই আশঙ্কা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ভারত যেভাবে চিন্তা করে, যুক্তরাষ্ট্র সেভাবে চিন্তা করে না। তারা মনে করে, জামায়তসহ ওই ধরনের দলগুলোকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনলে সমস্যার সমাধান হবে। আর যদি কোনো দল পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে অ্যামেরিকার পক্ষে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হবে। তারা শুধু সমর্থন নয়, তারা তাদের সব কাজে পুরোপুরি বাংলাদেশকে সাথে চায় এখন।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে বা হবে না এই নিশ্চয়তা কে কাকে দিতে পারে?’
আর হুমায়ুন কবীরের কথা, ‘জঙ্গিবাদ বহুকাল ধরেই অ্যামেরিকা, ভারতের গ্লোবাল ইস্যু। এখানে কোনো সরকার জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। আর এ দেশের সাধারণ মানুষ জঙ্গিবিরোধী।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে