সি আর দত্তের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, বীর উত্তমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) পৃথক শোকবার্তায় এ শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি সি আর দত্তের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্তের ভূমিকা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
অপর এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে সি আর দত্তের অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞ চিত্তে সঙ্গে স্মরণ করবে।’ প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বয়েন্টনবিচের বেথেসডা সাউথ হাসপাতালের হসপিস কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল) মারা যান সি আর দত্ত। বীর উত্তম খেতাবধারী এই মুক্তিযোদ্ধার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। মৃত্যুকালে সি আর দত্ত দুই মেয়ে, এক ছেলে ও অসংখ্যা স্বজন রেখে গেছেন।
সি আর দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বেশ কয়েক বছর ধরেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত এবং ছেলে ডা. রাজা দত্ত সেখানেই থাকেন। গত বিজয় দিবসে নিউ ইয়র্কে রাজা দত্তের বাসায় যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আয়োজনে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে একাত্তরের স্মৃতিচারণ করেন তিনি। সে সময় তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কোনো অনুষ্ঠানে সেটাই ছিল তার সবশেষ বক্তৃতা। গত বছরের শেষ দিক থেকে ফ্লোরিডায় ছোট মেয়ে কবিতা দাসগুপ্ত হ্যাপির বাসায় চলে যান সি আর দত্ত। মার্চে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে নিউ ইয়র্কে না ফিরে তিনি ফ্লোরিডাতেই থেকে যান।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে চান তারা। তার আরেক মেয়ে কানাডা থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন বাবার মরদেহ গ্রহণ করার জন্য।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের রাজধানী শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন সি আর দত্ত। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার। প্রাথমিক শিক্ষা শিলংয়ে শুরু হলেও পরে তার পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসে হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাসের পর খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন সি আর দত্ত। ১৯৫১ সালে যোগ দেন তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন সি আর দত্ত। সেই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্ত যখন উপস্থিত, সে সময় ছুটিতে দেশেই ছিলেন সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর সি আর দত্ত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তাকে দেওয়া হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর সেক্টর ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান।
সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন তিনি। রণকৌশলের অংশ হিসেবে পরে রশীদপুর থেকে ক্যাম্প সরিয়ে নেন মৌলভীবাজারে। ওই সেক্টরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বেশ কয়েকটিতে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তার দায়িত্ব দেওয়া হয় সি আর দত্তকে। বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহা পরিচালক তিনি। পরে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান সি আর দত্ত। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন সি আর দত্ত।