বাঙালি ঐতিহ্যে ভাওয়াইয়া গান
একটি জাতির পরিচিতি তার ভাষা ও কৃষ্টির ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল। দেশ ও জাতির সার্বিক সমৃদ্ধির জন্য জাতীয় সংস্কৃতির যথাযথ মূল্যায়ন একান্ত অপরিহার্য। তাই বিদগ্ধজন মানবকল্যণমুখী চলমান এবং পরম্পরায় সংস্কৃতির ধারাকে সমুন্নত রাখার জন্য দৃঢ় মনোভাব পোষণ করেন, যা সামগ্রিকভাবে অপরিহার্য।
মানবজীবনে পার্থিব ও অপার্থিব সম্পদ নিয়ে সামাজিক নানা টানাপোড়েন চলে। তাই পার্থিব সম্পদের চেয়ে অনেক সময় অপার্থিব সম্পদই মনে হয় শ্রেয়। সেই সম্পদই হলো আমাদের মনোজগতের ভাবসম্পদ। সেই ভাব-সম্পদের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ আমাদের ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গান বাঙালি হৃদয়ে সার্বজনীন বহিপ্রকাশ হলেও উৎপত্তিস্থল হিসেবে তা আঞ্চলিক গান বলেই স্বীকৃত। এর উপৎত্তি বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুর অঞ্চল, ভারতের কোচবিহার, আসাম ও জলপাইগুড়ি অঞ্চলের আশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে।
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি অন্যতম ধারা ও লোকসংগীতের ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ধারক ও বাহক। লোকসংগীতে আছে জারিসারি, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, লালন, হাসন, গম্ভীরা ইত্যাদি। তবে লোকসংগীতের উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে এই ভাওয়াইয়া। সংগীতের নামকরণেও রয়েছে সুস্পষ্ট অর্থবোধক দ্যোতনা।
যে নৌকা বায় সে নৌকা বাওয়াইয়া। যে হালচাষ করে বা বায় সে হাল বাওয়াইয়া। আবার যে মহিষ চড়ায় (মইষাল) সেও বাওয়াইয়া। অতএব নৌকা বায়, হাল বায়, বোঝা বায় বা মহিষ বায়- এই শ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণার কথা ও সুরের যে বিরহগাথা আমরা পাই, তাই বাওয়াইয়া। আর এই ‘বাওয়াইয়া’ থেকেই ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দের উৎপত্তি।
বহমান স্রোতস্বিনী তিস্তা, তোরষা, ধরলা, ঘাঘট, ক্ষীরল ও ব্রহ্মপুত্রের তীরে যে জনপদ গড়ে উঠেছে সেই জনপদের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, মাহুত, মইষাল, রাখাল, গাড়িয়াল ও বইদালরা পথেপ্রান্তরে গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে অথবা পায়ে হেঁটে ধান-পাট-তামাক ক্ষেতে উদাসী প্রহরে কাজার ফাঁকে ফাঁকে খালি গলায় যে গীত হতো তাই ভাওয়াইয়া।
উত্তর জনপদের মানুষ দারিদ্র্যকে লালন করেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের জীবনে নেই কোনো জটিলতা, নেই কোনো বড় ধরনের আশা–আকাঙ্ক্ষা। একেবারেই আটপৌরে জীবন তাদের। কিন্তু আছে গভীর অনুভূতিপ্রবণ সহজ-সরল জীবন। যে জীবন বাস্তব অথচ অন্তর্মুখী। সেসব সহজ-সরল গ্রামীণ জনপদের অধিবাসীর নিজস্ব ভাষায় রচিত ভাওয়াইয়া গান। আটপৌরে জীবনের গভীর মমত্ববোধ আছে এই গানে।
আঞ্চলিক ভাষা হয়তো অনেকের কাছে সবসময় বোধগম্য হয় না। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, সব কথ্য ভাষাই কিন্তু উন্নত ভাষার আদি কিংবা প্রাকৃত রূপ থেকে আহৃত। গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন স্নিগ্ধ-শান্ত, তেমনি সহজ সরল জীবনাচরণ ও সরল মনের স্বচ্ছন্দ প্রকাশ পেয়েছে ভাওয়াইয়া গানে। ভাওয়াইয়া গানে একজন মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, বিশেষ করে নারীর শোষণ, বঞ্চনা, আবহেলা, অনাদর, ক্ষোভ ও আশাভঙ্গের বেদনা ফুটে উঠেছে অতি সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে। পল্লীবালার প্রেমিক অথবা স্বামীর জন্য কামনা-বাসনার আকুল আর্তির প্রকাশ ঘটেছে এ গানে। ভাওয়াইয়া গানের এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তির সময় নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ত্রয়োদশ অথবা চতুর্দশ শতকে ভাওয়াইয়া গানের জন্ম। এ গানের সমসাময়িক অন্যান্য সংগীত গবেষকরা সংগীত ও সাহিত্য বিশ্লেষণ শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভাওয়াইয়া গানের উদ্ভবকাল পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকে। ভাওয়াইয়া গানে আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, ময়মনসিংহ গীতিকার প্রভাব দেখতে পাই এবং সে কারণেই আমরা ধারণা করি ভাওয়াইয়া সংগীত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী ও ময়মনসিংহ গীতিকার সমসাময়িক অথবা পরবর্তী রচনা।
ভাওয়াইয়ার প্রধান সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে- দোতরা ও বাঁশি। এছাড়া আরও ১৯ ধরনের লোকবাদ্যযন্ত্র আছে উত্তরাঞ্চলে। যেগুলো ভাওয়াইয়া সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। যেমন- একতারা, করতাল, খাপী, মন্দিরা, সানাই, কাঁশি, ঢাক, ঝড়কা, কড়কা, খোল, ঢোল, আখরাই, খমক, মুখবাঁশি, বমবাঁশি, আড়বাঁশি, সারিন্দা, ব্যানা ও ঘুঙুর।
কিছু বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান আছে। তাতে ভাবের কি উপকরণ আছে তা আমরা জানবো।
১. ওকি গাড়িয়াল ভাই…..
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়ারে
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মোর ঝইরা রয়রে
ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে
২. যেজন প্রেমের ভাব জানে না
তার সঙ্গে নাই লেনা দেনা
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা
সে জন সোনা চেনে না
৩. বাওকুমটা বাতাস য্যামন ঘরিয়া ঘুরিয়া মরে
ওরে ওই মতন মোর গাড়ির চাকা পন্থে পন্থে ঘোরেরে
ওকি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজপন্থে
৪. ওকি ও কাজল ভ্রমরারে
কোনদিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাওরে
৫. আজি ধীরে বোলাও গাড়িরে গাড়িয়াল
আস্তে বোলাও গাড়ি
আর এক নজর দেখিয়া ন্যাও মুঁই
দয়ার বাপের বাড়িরে
গাড়িয়াল আস্তে বোলাও গাড়ি।
বাপ ছাড়িনু, মাও ছাড়িনু, ছাড়নু ঘর ও বাড়ি
অল্প বয়সে ও মোর গাড়িয়াল
যাওঁছি শ্বশুরবাড়ি-
গাড়িয়াল আস্তে বোলাও গাড়ি।
এ গানগুলোতে একজন বিরোহিনী নারীর প্রেমিক স্বামীর অপেক্ষায় কাতর হৃদয়ের আর্তি যেন গরুর গাড়ির চাকার শব্দে সৃষ্টি হয় এক করুণ আর্তনাদ। ঠিক প্রিয়ার আর্তচিৎকার যেন। মনের এ নিদারুণ ব্যথা গরুর গাড়ির চাকার শব্দে মিশে একাকার হয়ে বাতাস ভারী হয়ে আসে।
আবার কখনও পাই উদাসী গাড়িয়ালের মানসিক অবস্থার বর্ণনা। সে বিচ্ছেদের হৃদয়স্পর্শী প্রকাশ এই ভাওয়াইয়া গানে। আঞ্চলিক শব্দের সফল ব্যবহারে যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ উত্তর জনপদের আঞ্চলিক ভাওয়াইয়া সংগীত। যা দেশ-কাল-পাত্র উত্তীর্ণ হয়ে আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়। তাই আমাদের দেশের সাহিত্যিক, গবেষক ও সংগীতজ্ঞ সমাজ এগিয়ে আসবেন এ ভাবসম্পদ সংরক্ষণ, সংগ্রহ, গবেষণা ও সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য।
আজ ভাওয়াইয়া সংগীতের যে উত্তরণ ঘটেছে তার পেছনে রয়েছে অনেক জ্ঞানী, গুণী ও সংগীতজ্ঞের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। যার দরুণ ভাওয়াইয়া গান আজ নদীকূলের দু’পাড়ের জনগণের মধ্যে থেকে এসে স্থান করে নিয়েছে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত শিক্ষিত মানুষের ড্রয়িংরুমে। আধুনিক মানুষের চেতনায় রোপণ করেছে লোকসংস্কৃতির বীজকে। আশার কথা, আধুনিক রুচিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছেও আজ তুমুল জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া সংগীত।
যাদের লেখনিতে ভাওয়াইয়া গানকে আমরা বিস্তারিত পাই, তারা হলেন- হরিষ চন্দ্র পাল, শ্রী সতীন্দ্র দে সরকার, শ্রী শিবেন্দ্র নারায়ণ মণ্ডল, শ্রী অধ্যাপক হিতেন নাগ ও ড. সুখবিলাস বর্মা প্রমুখ।
ভাওয়াইয়া গানকে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ করতে মরহুম আব্বাস উদ্দিন ছাড়াও যে গুণী শিল্পীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তারা হলেন- মরহুম আব্দুল করিম, স্বর্গীয় হরলাল রায়, স্বর্গীয় মহেশ চন্দ্র রায়, মরহুম মকবুল আলী, মরহুম নমরুদ্দিন, মরহুম একেএম আব্দুল আজিজসহ আরও অনেকে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশবরেণ্য কালজয়ী শিল্পী ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দরদি কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ভাওয়াইয়া গান। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো, তিনিই প্রথম গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া অশিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে তুলে এনে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ভাওয়াইয়া উত্তরণের যে নায়ক, তার সম্পর্কে দু’চারটি কথা না বললেই নয়। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমেদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর কোচবিহার জেলার কালজানি নদীর তীরে বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভী মো. জাফর আলী আহমেদ ছিলেন একজন আইনজীবী। মায়ের নাম ছিল হীরামন নেছা।
আব্বস উদ্দিন আহমেদ ১৯২০ সালের কোচবিহারের তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। কলেজ জীবন শুরু করেন কোচবিহার কলেজে। এরপর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ এবং পরে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু বেশিদিন সেখানে অবস্থান করেননি তিনি। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন কোচবিহার কলেজ থেকে।
একসময় তিনি লক্ষ্নৌ মরিস সংগীত কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলে বাবার অনুমতি না থাকায় আর ইচ্ছে পূরণ হয়নি। সংগীতে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ছিল না কোনো ওস্তাদের কাছে শিক্ষার সুযোগ। এ স্বভাব গায়কের গান শুনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কবি তাকে কোলকাতায় আমন্ত্রণ জানান। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তার গান বের হতে থাকে। গানগুলো সে সময় প্রচুর শ্রোতানন্দিত হয়। এরপর আব্বাস উদ্দিন কোলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরে ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় সপরিবারে চলে আসেন।
আব্বাস উদ্দিন আহমেদের প্রায় ৩৭টি গান গ্রামোফোন রেকর্ডে বেরিয়েছিল। মূলত তিনি ভাওয়াইয়া অন্তঃপ্রাণ হলেও পল্লী গানের বিভিন্ন শাখায় তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। কাজী নজরুলের ইসলামী গানকে তিনি কণ্ঠে ধারণ করে সুচনা করেছিলেন মুসলিম রেনেসাঁর। ভাওয়াইয়া ও ইসলামী গানের পাশাপাশি তিনি আরও গেয়েছেন পল্লীগীতি, জারিসারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মর্শিয়া, মারফতি, হামদ্-নাত ও পালাগান ইত্যাদি।
তার আরেকটি গুণের কথা আমরা অনেকেই জানি না। তা হলো, তিনি একজন ভালো অভিনেতাও ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, পরিচ্ছন্ন, পরিমার্জিত ও পরিশীলিত। তার ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন ও সংগীত জীবনের অনুপ্রেরণা ছিলেন তার সুযোগ্য স্ত্রী লুৎফুন্নেসা আব্বাসী। আব্বাস উদ্দিনের বড় সন্তান মোস্তফা কামাল আব্বাসী, ছোট ছেলে মোস্তফা জামান আব্বাসী, মেয়ে ফেরদৌসী রহমান, ছেলের বউ আসমা আব্বাসী, নাতনি ড. নাশিদ কামাল স্বস্ব ক্ষেত্রে আজ স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আব্বাস উদ্দিনের কৃতজ্ঞতার জায়গায় ছিলেন অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। যারা অনেকেই আজ গত।
ভাওয়াইয়া গানের এই মুকুটহীন সম্রাট দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর ১৯৫৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর অতিপ্রত্যুষে সংগীত ও শ্রোতার এই সম্রাজ্য ছেড়ে চলে যান মহান গাড়িয়ালের উদ্দেশে অজানা-অচেনা-অদেখা কোনো এক চিলমারীর বন্দরে।