কে আসলে বন্ধু?
বন্ধুত্ব মজার সম্পর্ক। অন্য সব সম্পর্কের মতো বন্ধুত্বে কোনো বস্তুগত দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। বাকি অনেক সম্পর্কের মতো বন্ধুত্বে কোনো আইনি বা পারিবারিক বাধ্যবাধকতাও নেই। পুরোটাই মনের মিল। সেই মিল বিভিন্ন রকম হতে পারে। সে কারণেই বন্ধুও বিভিন্ন ধরনের হয়।
কিছু বন্ধুত্ব হয় একই ধরনের আগ্রহ বা শখের জায়গা থেকে। দুজন খুব ক্রিকেট অনুরাগী মানুষ বন্ধু হতে পারেন, যদিও তাঁদের আর কোনো বিষয়ে মিলের জায়গা নেই, অথবা থাকলে তাঁরা সেটা জানেন না। আমার এ রকম একজন বন্ধু সজল। পাহাড়ের ব্যাপারে তার গভীর আগ্রহ। আমারও। অবশ্য আগ্রহ-মিটারে সে আমার চেয়ে বেশ কয়েক ডিগ্রি ওপরে। যেখানে আমার শখ পাহাড়ের কাছে যাওয়া, তার কাজ পাহাড়ে চড়া। তার কাছ থেকে পাহাড়ের গল্প শুনি। পর্বতারোহীদের গল্প শুনি। সে আমার আগ্রহ দেখে মজা পায়, আমাকে গল্প শুনিয়ে মজা পায়। এই আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি। এর বাইরে একজন আরেকজনের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানি না। জানার প্রয়োজনও বোধ করি না। আমাদের বন্ধুত্বের জন্য পাহাড়ের ভালোবাসাই যথেষ্ট।
অভিজ্ঞতা অথবা আগ্রহের মিল নেই; কিন্তু কোথায় যেন এক আত্মিক টান আছে। সে কারণেও গভীর বন্ধুত্ব হতে পারে। আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি-জীবনে জিনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন হয়তো একজন আরেকজনের সঙ্গে আড্ডা হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার। ইউনিভার্সিটির পরে আমরা কখনোই আর এক জায়গায় থাকিনি। দেখাও হয়নি। তবে বছরের পর বছর বন্ধুত্ব টিকে গেছে। যোগাযোগ বিছিন্ন হয়েছে বেশ কয়েকবার, তারপর কোনো না কোনোভাবে একজন আরেকজনকে খুঁজে বের করেছি। আমাদের জীবন প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভিন্ন। আগ্রহ, ধর্ম, বর্ণ, অভিজ্ঞতা। তারপর বন্ধুত্ব অটুট। একজন আরেকজনের দুঃখ-কষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গভীর আলোচনা। আলোচনা শেষে আবার মাসের পর মাস হয়তো কয়েক বছর যোগাযোগ বিছিন্ন। আবার গভীর আলোচনা। গভীর কৌতূহল। গভীর সখ্য।
তারপর ধরা যাক আমার ফারুক ভাইয়ের কথা। আগ্রহের জায়গা থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে মিল কিছু আছে বৈকি। তবে আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি একজন আরেকজনের সঙ্গে অমিলের জায়গাগুলো খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে একজন আরেকজনকে খোঁচানো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভয়ংকর ধরনের তর্ক-ঝগড়া করা। কোনো এক কারণে এতেই বন্ধুত্ব আরও শক্ত হয়ে ওঠে। একজন আরেকজনের প্রতি স্নেহ-মমতা বাড়ে।
একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটানো, অনেক অভিজ্ঞতা শেয়ার করাই হয়তো বন্ধুত্বের সবচেয়ে প্রচলিত কারণ। আতিফ আমার কলেজজীবন থেকে সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের মধ্যে একজন। কলেজের পর এক শহরে থাকলে যতটুকু সময় পাই তার সঙ্গে বেশি সময় কাটানো হয়। গান শোনা, খেলা দেখা, আড্ডা, জীবনে প্রেম এবং নারী-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে আলোচনা, আর যা কিছু আছে সব নিয়েই আমাদের বন্ধুত্ব। আতিফের পরিবারের সবাই আমার পরিবারের মতো হয়ে গেছে। আমার পরিবারের সদস্যরাও আতিফের কাছে তা-ই।
আতিফ, সজল, ফারুক ভাই, জিনা—সবার সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব অবিস্মরণীয় এবং সুমধুর। অথচ বন্ধুত্বের সূত্র ক্ষেত্র ও কারণে কিন্তু কোনো মিল নেই। মিল শুধু একটি জায়গায়। তাঁরা আর কেউ আমার সঙ্গে এখন নেই। চলে গেছেন। এই পৃথিবী থেকে তাঁদের আমি হারিয়েছি।
বন্ধুত্ব নিয়ে আমরা অনেক সময়ই নানা ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকি। কোনটা আসল বন্ধুত্ব, কে প্রকৃত বন্ধু? এসব নিয়ে আমরা মনে হয় একটু বেশি চিন্তা করি। এই লেখার শুরুতেই যা বললাম। বন্ধুত্বের ব্যাপারে অসাধারণ বিষয়টি হচ্ছে যে বন্ধুত্বে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সে কারণেই আমার মনে হয় বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিয়মেরও প্রয়োজন কম। যদি একজন আরেকজনকে নির্মল আনন্দ দিতে পারি, যদি সম্পর্কের কারণে জীবনের প্রতি ভালো লাগা বাড়ে তাহলেই বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে চালিয়ে যাওয়া যায় তাহলে সম্পর্ক গভীর হতে বাধ্য।
বন্ধুদের কাছে বেশি প্রত্যাশা করাও উচিত না। নিজের বিপদ হবে জেনেও যে বন্ধু পাশে দাঁড়ায় সে হচ্ছে ব্যতিক্রম ধরনের বন্ধু।
এমন বন্ধু জীবনে কমই হবে সেটাই স্বাভাবিক।
২০১৬ বছরটিতে ব্যক্তিগত জীবনে কিছু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছি। সেই বাধার মোকাবিলা করছি এবং করব। করতেই হবে। থামার তো কোনো উপায় নেই। তবে কঠিন সময়গুলোতে বারবার বন্ধুত্বের মূল্য আমি বুঝতে পেরেছি।
বন্ধুত্বের কারণ যা-ই হয়ে থাক না কেন, সেটা তাদের পাশে দাঁড়ানোর শক্তির ওপর প্রভাব ফেলেনি। জীবনের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে যারা বন্ধু হয়েছে, সবাই একই সংকল্পে আমাকে সাহায্য করেছে এবং আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতেও করবে।
তাদের কারও কারও কথা বলে নিজেকে বড় করতে চাই না বা যাদের নাম ভুলে গেছি, তাদের ছোট করতে চাই না। যে বন্ধুরা চলে গেছে তাদের কথা স্মরণ করে যারা আছে, তাদের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিতে চাই।
আর আরেকটা কথা না বললেই নয়। কিছু সম্পর্ক হয়তো সাধারণ বন্ধুত্বের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। সেই সম্পর্ক অসাধারণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে। নিজের জীবনে আমি আমার বাবা-মা-বোনের কাছে যে বন্ধুত্ব পেয়েছি, সেটা আমার জীবনকে অনেক সুন্দর করেছে। আমার পরিবারের কাছে যে বন্ধুসুলভ আচরণ পেয়েছি, তা আমার জীবনকে মধুর করেছে। হয়তো বন্ধুত্বের সংজ্ঞা খোঁজাটাই ভুল। তার চেয়ে আমরা নতুন বন্ধু খুঁজি আর পুরোনো বন্ধুদের কাছে রাখি।
বন্ধুদের সঙ্গে সবার নতুন বছরটা খুব ভালো কাটুক—এই কামনা করি।
লেখক: অভিনেতা