জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কান্না (১),কলেজ নয় যেন পরীক্ষা কেন্দ্র
উচ্চ শিক্ষায় বৃহৎসংখ্যক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ না পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী যান বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা নাম লেখান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এসব শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভোগেন হতাশায়। তারা পান না উচ্চ শিক্ষার আধুনিক সুবিধা। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজ আছে ২২৭৪টি। এর মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজ। স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় ১৮১টি সরকারি কলেজে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এসব শিক্ষার্থীর প্রধান অভিযোগ ক্লাস না হওয়া।
কারমাইকেল কলেজ রংপুরের শিক্ষার্থী জ্যাকেল বাবু বলেন, নিয়ম অনুযায়ী বছরে ২১০দিন ক্লাস পাওয়ার কথা শিক্ষার্থীদের। কিন্তু আমরা বছরে পূর্ণ ক্লাস হিসাব করলে ক্লাস পাই ৪০ থেকে ৫০ দিন। আমাদের লেখাপড়াটা এখন শুধু পরীক্ষার অপেক্ষা করা।
এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনার শিক্ষার্থী আসমা হক আশা বলেন, আমাদের ক্লাস এমন হয়ে গেছে যে, আমরা আর খোঁজই রাখি না কবে ক্লাস। শুধু খোঁজ রাখতে হয় কবে পরীক্ষা। আর আমাদের ক্লাসের শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট ১২০ জন। আর ক্লাসে বসার আসন রয়েছে ৪০ থেকে ৫০ জনের। তারপরও ফাঁকা রয়ে যায় ক্লাসরুম।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা কলেজগুলো যেন একেকটা পরীক্ষা কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, কলেজের পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষার চাপে ক্লাস হারাচ্ছে গুরুত্ব। শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষে একটু নিয়মিত কলেজে গেলেও পরবর্তীতে আর যান না। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজের এমন অবস্থা হয়ে গেছে নিজের কলেজ চিনি না অনেক সময়। সবসময় কোননা কোনো পরীক্ষা লেগেই আছে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি পরীক্ষার। তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, দ্বিতীয় বর্ষে একটা পরীক্ষাও দেইনি আমি। প্রতিটি বিষয় প্রতি ২০০ টাকা করে জরিমানা দিতে হয়েছে। আর অফিস সহকারীকে ৫০০ টাকা দিয়ে উপস্থিতির ২০ নম্বর পেয়েছি।
এই শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, ক্লাসে শিক্ষার্থীরাও উপস্থিত হন না ক্লাসও হয় না। আবার রংপুর মডেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা কলেজে যেয়ে যদি ক্লাসের কথা বলি শিক্ষকরা বিরক্ত হন। উপস্থিতি খুবই কম থাকায় ক্লাসও হয় না। আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬৩ জন। কিছুদিন আগে ইনকোর্স পরীক্ষা দিলাম যাতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১২ জন। বাকী সবাই টাকা দিয়ে পাস করিয়ে নেবে। তিনি বলেন, একেক শিক্ষার্থীর কাছে একেক পরিমাণ অর্থ নেয়া হয়। যার কাছে যেমন পায়। ৫০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। আর খাতা-কলমে আমরা সকলেই ৮০ শতাংশ সময় উপস্থিত থাকি ক্লাসে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা একেবারেই এমন নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন শহরের বেসরকারি কলেজগুলোর চিত্র কিছুটা ভিন্ন। লালমাটিয়া মহিলা কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামিয়া জান্নাত বলেন, আমাদের কলেজে উপস্থিত না থাকলেও ইনকোর্স পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। না হলে জরিমানা দিয়ে পুনরায় পরীক্ষায় বসতে হয়। তিনি বলেন, ক্লাসে আমার উপস্থিতিটা অতোটা গুরুত্বপূর্ণ না। আর আমাদেরও ক্লাস নিয়ে নেই মাথাব্যথা। শুধু্ পরীক্ষার অপেক্ষা করি আমরা।
আর এসব শিক্ষার্থীর পরীক্ষা মানেই সাজেশন বিক্রির ধুম লেগে যায়। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীদের সাজেশন কেন্দ্রীক লেখপড়ার কারণে বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। লালমাটিয়া মহিলা কলেজের আরেক শিক্ষার্থী শ্রেয়সী শ্রেয়া বলেন, আমাদের অধিকাংশরই কারো কাছে মূল বই নাই। আর জাতীয় প্রশ্ন যেহেতু সালকেন্দ্রিক প্রশ্ন বেশি হয় তাই সাজেশনের দিকেই বেশি ঝুঁকতে হয়। অনেক সময় লাইব্রেরিগুলোতে মূল বই পাওয়াও যায় না। এবার আমার পুরো গাইড সেট কিনতে খরচ হয়েছে ১৩০০ টাকা। আর মূল বই কিনলে লাগতো ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর আমাদের অবস্থা এমন মূল বইয়ের রংটা কেমন সেটাও বলতে পারবো না।