ই-কমার্স কী? ই-কমার্স শুরু করতে চাইলে যা করবেন
ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন ও সুবিধা ব্যবহার করাকে ই-কমার্স বলে। এটি ইন্টারনেট কমার্সকে সংক্ষেপে ই-কমার্স বলা হয়। অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা এর সহজ উদাহরণ। বস্তুত, যে কোনো ব্যবসায় ইলেক্ট্রনিক্সের মাধ্যমে পরিচালনা করাই হলো ই-কমার্স। যেমন-
অনলাইন শপিং
পণ্য অনলাইনে বেচাকেনা ই-কমার্সের সহজ একটি উদাহরণ। এখানে বিক্রেতারা অনলাইনে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপন দেয়। ক্রেতারা তা দেখে মাউসের ক্লিকের মাধ্যমে তা কেনেন। Amazon.com এরকম অন্যতম একটি ওয়েবসাইট যেখানে পণ্য বা সেবা অনলাইনে বেচাকেনা করা হয়, তবে বাংলাদেশে এর পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। বাংলাদেশে কয়েকটি E-Commerce ভিত্তিক ওয়েবসাইট এর নাম হলো- www.bagdoom.com, www.rokomari.com, www.ajkerdeal.com, www.chaldal.com ইত্যাদি।
ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট
যখন আপনি অনলাইনে কিছু কিনবেন, তখন অনলাইনে তার দাম দেয়ার জন্য মেকানিজমও আপনার থাকতে হবে। এর কারণে গ্রাহক-গ্রহীতা দুজনই একটা ছবির মধ্যে চলে আসেন। ই-পেমেন্টে অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম যেমন মেইলিং করা এসব করতে হয় না। একই সঙ্গে এটি বিভিন্ন অনিশ্চয়তা থেকেও রেহাই দেয়। যেমন- www.easy.com.bd, www.paypoint.shurjorajjo.com.bd ইত্যাদি।
অনলাইন নিলাম
আপনি যখন অনলাইন নিলামের কথা ভাবেন তখনই আপনার মনে আসে ই-বে এর কথা। বাস্তবে কিছু নিলাম করতে হলে কতিপয় লোকের কাছে আপনাকে নির্দিষ্ট দিনে তা করতে হয়, কিন্তু অনলাইন নিলামে আপনি স্বল্পসময়ে অসংখ্য মানুষের কাছে কোনো কিছু নিলাম করতে পারবেন। অনেকেই বাস্তব বেচাকেনার চেয়ে অনলাইন নিলামকে এজন্য বেশি পছন্দ করে। বাংলাদেশে এর পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
ইন্টারনেট ব্যাংকিং
বর্তমানে ব্যাংকের কোনো অফিসে শারীরিকভাবে না গিয়েই আপনি ব্যাংকের যাবতীয় কার্যক্রম সারতে পারবেন। এভাবে আপনি ক্রেডিট কার্ডও নিতে পারবেন। যা ই-কমার্সের বড় সাফল্য।
অনলাইন টিকেটিং
বিমান, ট্রেন, খেলা বা সিনেমা হলের টিকেট আপনি এখন অনলাইনে খুব সহজেই করে ফেলতে পারেন। এজন্য আপনাকে কাউন্টারে গিয়ে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। ট্রেনের টিকেট www.esheba.cnsbd.com থেকে আপনি কিনতে পারবেন।
ই-কমার্স শুরু করতে চাইলে
আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি সব বয়সের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি ঝুঁকছে। ফলে ই-কমার্সেও সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হচ্ছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার, বিদ্যুৎ পরিস্থতির উন্নতি, স্মার্টফোন ইত্যাদি কারণে অনলাইন ব্যবসার অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি শিপিং সার্ভিস, পেমেন্ট জটিলতা, সাপ্লাই চেইন, পেশাদারিত্বসহ বেশকিছু সমস্যাও রয়েছে। ঠিক এইপর্যায়ে কেউ যদি ই-কমার্সের কথা ভাবেন। তার জন্য নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়টি সর্ম্পকিত জ্ঞানার্জন
একটা কাজ যত কঠিন বা সহজ হোক না কেনো, সে বিষয়ে কাজ করার জন্য জ্ঞান থাকা চাই। যত বেশি জানা থাকবে তত বেশি সহজ মনে হবে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার আশঙ্কা থাকবে না। যত বেশি তথ্য আপনার কাছে থাকবে তত বেশি রাস্তাও আপনার জানা থাকবে। তাই ই-কমার্সকে সহজ মনে করে হেলাফেলা করবেন না। একটা কাজ যতই সহজ হোক, যখনি আপনি সিরিয়াস হবেন, সে কাজ থেকে তত বেশি সুফল পাবেন। মোটামুটি যেসব বিষয় ধারণা রাখবেন।
ন্যূনতম প্রস্তুতি
ই-কমার্স পুঁজি ছাড়া করা গেলেও সেভাবে করা ঠিক হবে না। কারণ ন্যূনতম পুঁজি খরচ করলে এর জন্য আপনার একটা টান থাকবে। টাকার জন্য মায়া হবে এতে আপনি কিছুটা সিরিয়াস হবেন। কোনো পয়সা খরচ না, হলে এমনটা নাও হতে পারে। তাই আপনি অন্তত যেকাজগুলো করবেন-
১. ওয়েবসাইট না খুললেও একটি ডোমেইন নিয়ে রাখতে পারেন।
২. ই-কমার্স সাইট না থাকলেও অন্তত একটি ফেসবুক পেইজ রাখবেন।
৩. টিন ভ্যাট না করলেও অন্তত একটি ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারেন। (যদি আপনি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবসা করতে চান, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।)
৪. প্রতিষ্ঠানের নামে না হলে, নিজের নামেও একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখতে পারেন।
৫. বয়স ১৮ না হলে ব্যাংক থেকে স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন।
৬. আর কিছু না হোক, অন্তত একটি বিকাশ অ্যাকাইন্ট খুলুন। (আমি ধরে নিয়েছি আপনার একটা স্মার্টফোন অথবা নেট কানেকশন আছে।)
৭. অফিস না থাকলে আপনার বাসার ঠিকানাটা ব্যবহার করতে পারেন।
ব্যবসা শেখা
প্রথমত : ব্যবসা শেখার ভালো পদ্ধতি হলো- আপনি যে ব্যবসা করতে চান সেরকম একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা। কেউ যদি আগে টেইলারিং শপে চাকরি করে, তার জন্য মালিক হিসেবে একটি টেইলারিং শপ চালানো সহজ তেমনি হোটেল, সেলুন এমনকি ই-কমার্সের জন্যও এটি প্রয়োজ্য। তাই আপনি ব্যবসা শেখার জন্য অল্প কিছু লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য কোনো ই-কমার্স শপে একটি চাকরি করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত : সেটা যদি আপনার পক্ষে সম্ভব না হয়, আপনি অন্য কোনো ই-কমার্সের সাথে যে কোনোভাবে একটি ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে পারেন। যেমন আপনি হয়তো তাদের যে কোনো একটি পন্যের সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নিতে পারেন। আপনার লাভ কম হলেও ২/৪ মাস করে আপনি শেখার চেষ্টা করুন।
তৃতীয়ত : কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে অল্প পুঁজিতে শুরু করতে পারেন। বিশেষকরে তাদেরকে সাথে নেবেন যাদের সাথে আপনার মনের মিল আছে এবং যারা ব্যবসাটা একটু বোঝে। এতে করে ব্যবসা যদি সফল হয় তাতেও আপনি কিছু শিখবেন, যা দিয়ে আপনি নিজে পরে ব্যবসা করতে পারবেন। আর এ সময় খুব বেশি বিনিয়োগ করার ব্যাপারে বুঝেশুনে করুন। আর যদি ব্যবসা পড়ে যায়, তাহলে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনি নতুন করে শুরু করুন।
পরীক্ষামূলক ই-কমার্স
আরেকটা ভালো বুদ্ধি হলো ব্যবসাটা শেখা, এর সুবিধা অসুবিধা জানা, বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া, সর্বোপরি আপনি কতোটা যোগ্য, তা যাচাই করার জন্য আপনি প্রথম যেকোনো একটি পণ্য নিয়ে ব্যবসাটা শুরু করতে পারেন।
যেমন ধরুন- আপনি বেচবেন একটি মাত্র পণ্য, সুন্দরবনের মধু। এক্ষেত্রে আপনাকে যা করতে হবে।
১. সাপ্লাইয়ের জন্য খুলনা বা বাগেরহাটে একজন বিশ্বস্ত সাপ্লায়ার ঠিক করতে হবে।
২. বোতলজাত করার পর কীভাবে পার্সেল করলে সমস্যা হবে না, তা ঠিক করতে হবে।
৩. কেনা কত পরবে, শিপিং কস্ট কতো, অন্যান্য খরচ কতো, লাভ করবেন কতো, এগুলো ঠিক করে বাজারে অন্যদের দাম কতো, সব মিলিয়ে একটা দাম ঠিক করতে হবে।
৪. কোন এলাকায় কাদের মাঝে বিক্রি করতে চান, সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
৫. অনলাইনে অর্ডারের পাশাপাশি ফোনে অর্ডারের বা আপডেট জানার ব্যবস্থা রাখবেন।
৬. সুন্দর একটি নাম দিয়ে ফেসবুক পেজ খুলবেন। ফ্রি অ্যাড সাইটগুলোতে অ্যাড দেবেন।
৭. কুরিয়ার, পার্সেল, ট্রান্সপোর্ট এবং ডাকবিভাগের সাথে আগেই কথা বলে নেবেন। ওজন হিসেবে চার্জ কেমন, তা হিসেব করে রাখবেন।
৮. পেমেন্টের জন্য অন্তত দুটো অপশন রাখবেন। ক. বিকাশ বা মোবাইল ট্রান্সফার, খ. ক্যাশ অন ডেলিভারি, কন্ডিশন ডেলিভারি। যা এসএ পরিবহন দিয়ে থাকে। অর্থাৎ আপনার গ্রাহক এস এ পরিবহন থেকে পণ্য নেয়ার সময় দাম মিটিয়ে দেবে। এসএ পরিবহন দাম পরে আপনাকে পৌছে দেবে। তবে এক্ষেত্রে হোম ডেলিভারি হয় না।
প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ
উপরের যে কয়টি পদ্ধতি আছে আপনি যদি তার চেয়ে ভালোভাবে শুরু করতে চান তাহলে আপনি কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। তারপর শুরু করুন। বিষয়গুলো- ইংরেজি জানা, ওয়েবসাইট মেকিং, সাপ্লাইচেইন ম্যানেজমেন্ট ও ই-কমার্স। এর মধ্যে ইংরেজি ও আইটির জন্য ট্রেনিং সেন্টারের অভাব নেই। ই-কমার্স বিষয়ে ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে ট্রেনিং চালু হবে। যোগাযোগ রাখুন। আর বাকি থাকলো সাপ্লাই চেইন। এ ব্যাপারে কিছু সোর্স দেয়া হলো।
সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ‘পিজিডি ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট’ কোর্স চালু করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (বিআইএইচআরএম)। দেশে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছে অ্যাডভান্স সাপ্লাই চেইন সলিউশন বাংলাদেশ লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যেটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পারচেজিং অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের (সিআইপিএস) অধীনে পরিচালিত হয়। সবচেয়ে কম খরচ, BiMS Dhaka কারণ এখানে মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা যায়।
সুতরাং আপনি এখন খুব সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে ব্যবসার জন্য একাডেমিক ডিগ্রি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তেমনি পুঁজিও কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ব্যবসায়িক ডিগ্রি নিলেই যে আপনি ভালো ব্যবসায়ী হবেন, তা নয়। আপনার একটা ব্যবসায়িক মেজাজ ও মার্কেটসেন্স আপনাকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যদি আপনার মধ্যে থাকে আত্মবিশ্বাস, বাজার সম্পর্কে ধারণা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা, মানুষের সাথে মেশার সহজাত ক্ষমতা, সাহস ও গতি। সর্বোপরি আপনি যদি ব্যবসার ব্যাপারে দৃঢ়চিত্ত ও অধ্যাবসায়ী হন। প্রতিটি বিষয়ে সফলতার জন্য পরিশ্রম করতে প্রস্তুত থাকেন। তাহলে আপনার ই-কমার্স যুদ্ধে নামার এখনই সময়।