ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের জনক

0
Array

“দারিদ্র” একটি আপেক্ষিক শব্দ। পৃথিবী সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সকল পরিবার, সমাজ ও রাষ্টে দারিদ্র ছিল, আছে এবং থাকবে। সকল দেশ ও সমাজে দারিদ্রের ধরন স্থল, কাল ও পাত্র ভেদে একেক রকমের। যুগে যুগে মাুনষ তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্রকে জয় করার পরীক্ষায়  অবতীর্ণ হয়েছেন। এতে কেউ সফল হতে পেরেছেন আবার কেউ সফল হতে পারেন নি।

আধুনিক বিশ্বে যে সকল হাতে গোনা কিছু অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, দার্শনিক কিংবা শিল্পপতি আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে নানান মত ও তত্ত্বের ভিত্তিতে কাজ করে সফলতা অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছেন বাংলাদেশের কৃতি সন্তান শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে এ দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক দৃঢ় স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরই ১৯৭৬ সনে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক। যে ব্যাংকটিও দারিদ্র বিমোচনে কৃতকর্মের জন্য ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কারে ভুষিত হয়েছিলো। ১৯৭১ সনে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক মুক্তির সাথে সাথে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে রাজনৈতিকভাবে মুক্তি পেয়ে দেশ স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিকভাবে তখনো দেশের মানুষ মুক্ত হতে পারেনি। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখার জন্য বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করা শুরু করেন।

তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে অদ্যবধি তার নিজ হাতে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এদেশের দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তারই ফলাফল স্বরুপ ২০০৬ সালের ১৩ই অক্টোবর নরওয়ে ভিত্তিক নোবেল কমিটি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভুষিত করে। যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও স্বীকৃত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী তার কৃতকর্মের জন্য সম্মানীত ও সমাদৃত।
বর্তমানে তিনি দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে নতুন একটি ধারণা ও তত্ত্ব নিয়ে সারা পৃথিবীব্যাপী কাজ করে যাচ্ছেন। আর সেটি হলো সামাজিক ব্যবসা বা Social Business। সামাজিক ব্যবসার এই ধারণাটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন এবং সে লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্ভীক ও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হলো সামাজিক ব্যবসা বা Social Business কী? বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে দুটি তত্ত্ব দীর্ঘদিন যাবত প্রতিষ্ঠিত। আর তা হলো পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। নানা কারণে এখন আর সমাজতন্ত্র আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুুতে নেই। কিন্তু দোর্দন্ড প্রতাপে পুঁজিবাদ বিরাজ করছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সেই পুঁজিবাদও আজ নানা কারণে সংকট ও প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্বের ধনবাদী দেশগুলো এখন আর সনাতন পুঁজিবাদে সন্তুষ্ট নয়। তাদের অনেকে মনে করেন পুঁজিবাদের একটা সংস্কার হওয়া দরকার। এরকম বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ঋণের  উদ্ভাবক, বাংলদেশের গর্ব, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তার সাম্প্রতিক “সামাজিক ব্যবসা” তত্ত্ব। এই ব্যবসায় বিনিয়োগকারী একটা সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিনিয়োগ করবেন, কিন্তু সেই ব্যবসা থেকে বিনিয়োগকারী কোন ধরনের মুনাফা গ্রহণ করবেন না। শুধু বিনিয়োগের অর্থ তুলে নিতে পারবেন। মুনাফার অর্থ দিয়ে নতুন কোনো সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে পারেন অথবা বর্তমান ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে পারবেন। অর্থ্যাৎ বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় মুনাফা বৃদ্ধির যে উম্মাদনা দেখা যায় তার বাইরে ব্যবসাকে সামাজিক কল্যাণের জন্য নিয়ে আসাই সামাজিক ব্যবসার মূলকথা। একই সঙ্গে দেশে বিরাজমান নানা সমস্যার সমাধান করা হবে অনুদান বা চ্যারিটির ভঙ্গিতে নয় সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ সামাজিক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় সামাজিক ব্যবসার আওতায় বৃদ্ধ নিবাস করা হয়েছে। ২০১২ সালে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে এই বৃদ্ধ নিবাসে ২৫০ জন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। চীন, জার্মানী, জাপান, স্পেন, হাইতি, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, হংকং, উগান্ডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ব্যবসা একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বেকারত্ব এখন পুঁজিবাদের নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, এই সামাজিক ব্যবসা দিয়েই বর্তমান বিশ্বের বেকারত্বের সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তরুণ ও তরুণীদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ দিয়ে বেকারত্ব দূর করতে হবে। তার মতে, পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি আসবে যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না। একজন সুস্থ শরীরের লোক বেকার থাকবে এটা হতে পারে না। তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, তোমরা ব্যবসার ধারণা নিয়ে আসো। আমরা তোমাদের সহযোগিতা করবো। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, কাজের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা থাকা উচিৎ নয়। অবসর বলে কোনো শব্দই থাকা উচিৎ নয়। রিটায়ারমেন্টকেই রিটায়ারমেন্টে পাঠানো উচিৎ। তাই সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে দারিদ্র ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে মানুষকে স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার এই সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশ এগিয়ে আসবে এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরমের সম্মেলনে তিনি সামাজিক ব্যবসার ৭টি মূলনীতি ঘোষণা করেন।
সামাজিক ব্যবসার ৭টি মূলনীতি হলোঃ
১। দারিদ্র বিমোচনসহ এক বা একাধিক বিষয় যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাবিহীন কল্যাণকর ব্যবসা এটি।
২। সকলের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসার লক্ষ্য।
৩। সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা শধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবে, এর বাহিরে কোনো প্রকার লভ্যাংশ নিতে পারবে না।
৪। বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেয়ার পর বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা কোম্পানীর সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহৃত হবে।
৫। এ ব্যবসা হবে পরিবেশ বান্ধব।
৬। এখানে যারা কাজ করবেন তারা ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন।
৭। সামাজিক ব্যবসা হবে আনন্দের সাথে ব্যবসা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ১৯৪০ সালের ২৮শে জুন। এজন্য ২৮শে জুন এই দিবসটিই ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর সামাজিক ব্যবসা দিবস বা Social Business  Day হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিনটি পালন করার সার্বিক দায়িত্বে আছে ইউনূস সেন্টার।

লেখক,মোঃ মাহবুবুর রহমান বুলবুল

About Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat