২০১৬: মঞ্চে তারুণ্যের জয়গান

0

২০১৬ অত্যন্ত ঘটনাবহুল বছর ছিল আমাদের নাটকের ক্ষেত্রে। এ বছরই ২৭ সেপ্টেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রধান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হককে। আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের নাটকের আরও দুজন বন্ধু—ভারতের স্বনামধন্য নাট্যনির্দেশক কানহাইয়া লাল ও অমলেশ চক্রবর্তীকে। আমরা হারিয়েছি নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু, রাব্বীর মতো সম্ভাবনাময় নাট্যকর্মীদের। এত সব ক্ষতিকে পাশে সরিয়ে রেখে আমাদের নাটক ২০১৬ সালে জেগে উঠেছে নতুন শক্তিতে। বিশিষ্ট নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তনু হত্যার প্রতিবাদে মান্নান হীরার লেখা পথনাটক পরিষদের পথনাটক শিকারিরনির্দেশনা ও নিয়মিত প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রতিবাদী চেতনাকে।

 

গতি, অগ্রগতি কিংবা অসংগতি

 

গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতি অবস্থা বজায় থাকার কারণে নাটকের কর্মকাণ্ড যথেষ্ট গতিশীল ছিল। ফলে ২০১৬ সালকে আমরা পেয়েছি আমাদের মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে একটি ফলবান বছর হিসেবে। নিয়মিত নাটকের প্রদর্শনীর পাশাপাশি মহড়া ও নতুন নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে এ বছরটি ছিল ইতিবাচক ও গতিশীল। নতুন নাটক মঞ্চায়নে ক্ষেত্রবিশেষে যে অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি, যা একটু পরেই উল্লেখ করা হবে; সার্বিক নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে কিন্তু সে রকম তাত্পর্য কোনো ইঙ্গিত আমরা লক্ষ করি না। পাশাপাশি আমাদের নাট্য আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদেরকেও তেমন নতুন কোনো কাজে সক্রিয় হতে দেখতে পাইনি।

নতুনের ওড়ে কেতন

এ বছর বেশ কিছু তরুণ তাঁদের নতুন নতুন কাজ দেখিয়ে আশাবাদী করে তুলেছেন দর্শকদের। এ বছর তরুণদের কাজের পরিমাণ যেমন উল্লেখ করার মতো, তেমনি মানের দিক থেকেও তা বেশ উন্নত। বছরের শুরুতে তরুণ নাট্যকার ও শিক্ষক শাহমান মৈশান মঞ্চে আবির্ভূত হন তাঁর প্রকৃতি, চিত্রা ও অমলের চাড়ালনামা নাটক নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের এ প্রযোজনাটির নির্দেশনাও দেন তিনি। বছর শেষের নতুন নাটক সাধনা প্রযোজিত রিয়াজ মাহমুদ নির্দেশিত কালচৌতিশাও রচনা করেন মৈশান। শুধু শুরু আর শেষ নয়, বছরজুড়েই ছিল তরুণদের কাজের জয়জয়কার। তরুণ নির্দেশক হৃদি হকের নির্দেশনায় নাগরিক নাট্যাঙ্গনের গহর বাদশা ও বানেছা পরী বছরের প্রথমভাগেই দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেয়। পদাতিক নাট্য সংসদের নতুন প্রযোজনা সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত গহনযাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা পাই তরুণ নাট্যকার রুবাইয়াৎ আহমেদ ও অভিনয়শিল্পী শামছি আরা সায়কাকে। নূনা আফরোজের রচনা ও নির্দেশনায় প্রাঙ্গণে মোর-এর নতুন নাটক আমি এবং রবীন্দ্রনাথ’-এ তরুণ অভিনেতা রামিজ রাজুর অভিনয় সবার দৃষ্টি কাড়ে। ‘ধ্রুপদী’-এর একক অভিনয়ের নাটক নভেরায় আমরা পাই তরুণ অভিনয়শিল্পী সামিউন জাহানকে। আসাদুল ইসলামের রচনা ও সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় সুবচনের প্রণয় যমুনা তো তারুণ্যের কথাই বলে। রোকেয়া রফিক বেবি নির্দেশিত থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নতুন নাটক মর্ষকাম-এর মাধ্যমে আর্বিভূত হলেন তরুণতম নাট্যকার আনিকা মাহিন একা। থিয়েটার ৫২-এর প্রযোজনা নননপুরের মেলায় একজন কমলা সুন্দরী ও একটি বাঘ আসের নির্দেশক হিসেবে নিজের পারঙ্গমতার প্রমাণ রাখলেন তরুণ নির্দেশক জয়িতা মহলানবীশ। তরুণ নির্দেশক মুক্তনীলের নির্দেশনায় মঞ্চে এসেছে বাতিঘরের নাটক অলিখিত উপাখ্যান। আর এক তরুণ নাট্যকার মাহফুজা হিলালীর রচনা এবং দেবাশীষ ঘোষের নির্দেশনায় জাগরণী থিয়েটার মঞ্চে এনেছে রাজার চিঠি। নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার নির্দেশিত বটতলার প্রযোজনা ক্রাচের কর্নেল-এ সামিনা লুত্ফা নিত্রার পাশাপাশি নতুন নাট্যকার হিসেবে পাওয়া গেল সৌম্য সরকারকে। বঙ্গলোকের প্রযোজনা মর্ত্যের অরসিক-এ পাওয়া গেল নতুন নাট্যনির্দেশক শামীমা শওকতকে।

একটু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, অন্য যেকোনো বারের তুলনায় এবার তরুণেরাই অনেক বেশি এগিয়ে। সৃজনশীলতা ও দক্ষতার দিক থেকে এবার বেশিসংখ্যক নারী তাঁদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এত সংখ্যক নারী নাট্যকার ও নির্দেশক ইতিপূর্বে একসঙ্গে আমরা একই বছরে আগে আর পাইনি। জয় হোক নারীর।

আর এক নারী নাট্যকার সাধনা আহমেদ এবার আলোচনায় এসেছেনতাঁর মাব্রিং নাটক দিয়ে। কুশলী নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্কের অসাধারণ ডিজাইন ও নাট্যবিন্যাসে যশোরের বিবর্তন নাট্যদলের এ প্রযোজনাটি ঢাকার দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। রাজশাহীর অনুশীলনের নতুন নাটক মলয় ভৌমিকের এন্তারনেটও আলোচনায় ছিল এ বছর। থিয়েটার মঞ্চে এনেছে তরুণ নাট্যকার ও নির্দেশক মারুফকবিরের মায়া নদী। বছরের শেষ দিকে মঞ্চে এসেছে মান্নান হীরার রচনা ও নির্দেশনায় আরণ্যকের নতুন নাটক দ্য জুবলী হোটেল

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম

এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমসের আসরে মঞ্চায়িত হয় বাংলানাটক; তরুণ নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় থিয়েট্রিক্সের প্রযোজনায় দক্ষিণা সুন্দরী আন্তর্জাতিক আসরে আমাদের নাটককে গৌরবান্বিত করে। বুয়েটের ছাত্রদের দিয়ে নাটক করিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম ও পুরস্কার অর্জন করে আমাদের নাটককে ধন্য করেন আরেক তরুণ নির্দেশক বাকার বকুল

উৎসব-উদ্‌যোগে

এ বছর উল্লেখযোগ্য উত্সবগুলোর মধ্যে রয়েছে ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ‘ভাঙ্গাগড়া নাট্যোত্সব’, শেক্‌সপিয়ারের প্রয়াণের ৪০০ বছর পূর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজনে ২৩ ও ২৪ এপ্রিল ব্রিটিশ কাউন্সিলে ‘শেকস্‌পিয়ার সপ্তক’ শীর্ষক নাট্যমেলা। এরপর ‘গঙ্গা যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উত্সব’, শব্দাবলীর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন ধাপে বরিশাল, ঢাকা ও কলকাতায় তিনটি নাট্যোত্সব, আইটিআইয়ের ‘মনোড্রামা ফেস্টিভ্যাল’, মণিপুরি থিয়েটারের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা ও ঢাকায় দুই পর্যায়ের নাট্যোত্সব এবং অক্টোবরের ১ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত ‘বটতলার রঙ্গমেলা’। এসব উত্সবের বাইরে সুবচনের মহাজনের নাও এবং শূণ্যনের লালজমিন নাটক দুটির ১০০তম মঞ্চায়ন নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

হল নিয়ে কোলাহল

নাটক মঞ্চায়নে হলের সংকট অন্য যেকোনো বারের থেকে এবার বেশি ছিল। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে বছরজুড়ে বেশির ভাগ নাটকের দল সক্রিয় ছিল। বেশ কিছু বছর ধরে রাজধানীকেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলই ছিল একমাত্র ভরসা। এ বছর ২৭ ফেরুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক মহিলা সমিতির নতুন ভবন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। তবে হলভাড়া-সংক্রান্ত জটিলতা ও সরকারের ভর্তুকির মারপ্যাঁচে পড়ে নতুন ‘সম্ভাবনা’ এখনো ‘সম্ভব না’র পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ আশু কাম্য। তবে হল-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অনেকেই ছোট নাটক, রেপার্টরি বিকল্প নাট্যক্রিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছেন।

নানা রকম চড়াই-উতরাই, ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে আমাদের নাটক এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, সৃজনের ছন্দে। জয় হোক আমাদের নাটকের।

লেখক: নাট্যজন

About Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat
  • Click to Chat